
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম একটি জনবসতিপূর্ণ দেশ যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। পোল্ট্রি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ ৩য় হলেও পোল্ট্রি বিপণন থেকে প্রসেসিং পর্যন্ত যথাযথ আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশে মানসম্মত কোনো বিপণন ও জবাই ব্যবস্থাপনা নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বিশেষ করে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির চাহিদা বাড়ছে, তাই শহরে-গ্রামে পোল্ট্রির বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের দেশে স্থানীয় বাজারগুলোতে লাইভ বার্ড মার্কেট (এলবিএম) রয়েছে যেখানে সচরাচর জীবিত মুরগি বিক্রি হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে, বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারগুলো একটি ‘ব্রয়লার মাংস চেইন’ তৈরি করেছে, যেখানে সাধারণত ব্রয়লার এবং সোনালি মুরগি বিক্রি, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিভিন্ন অংশ কেটে বাজার এবং সুপারশপ উভয় জায়গায় বিক্রি হয়। এই প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে কারণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর এই দেশে পরিচ্ছন্ন ও হালালভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী। বন্দর, শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে এখানে প্রায় ৬০ লাখের অধিক লোকের বসবাস। পুষ্টি চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি প্রধান সহায়ক হওয়ায় শহরের আশপাশে এর খামারে গড়ে উঠেছে এবং খামার থেকে বাজারে মুরগির দোকানে (এলবিএম) পরিবহন করা হয়। তারপর মুরগিগুলোকে খাঁচায় বা দোকানের মেঝেতে রাখা হয়। কোনো ধরনের প্রোটোকল অনুসরণ করা ছাড়াই সাধারণত মুরগিগুলোকে জবাইের পর রক্তক্ষরণের জন্য ছেড়ে রাখা হয়, এবং ভোক্তাদের পছন্দ অনুযায়ী সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
মানসম্মত মুরগির কসাইখানায়, মুরগিগুলোকে জবাই-এর পূর্বে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে জবাই-এর পর রক্তক্ষরণের জন্য রাখা হয়। মুরগির প্রাণীকল্যাণের পর্যায়গুলো এর সঙ্গে যুক্ত যেমন, পরিবহনের সময়কাল, পরিবহনকালীন মৃত্যু, আঘাত ও ক্ষত এবং জবাইয়ের পরবর্তী অবস্থা ইত্যাদি। বাংলাদেশের জীবন্ত পশুপাখির বাজারে প্রাণী কল্যাণ বা অধিকারকে কীভাবে অবহেলা বা উপেক্ষা করা হয় সে সম্পর্কে খুব কম গবেষণা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, চট্টগ্রামে বাজারভিত্তিক সম্প্রতি এক গবেষণা হয় যার উদ্দেশ্য হলো বাজারের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা এবং ব্রয়লার বা সোনালি মুরগির কল্যাণে বিদ্যমান ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করা। গবেষণার তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের জীবন্ত পোল্ট্রি বাজারে প্রাণী কল্যাণ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত বলা যায়। নগরীর ব্যস্ততম বাজারগুলোতে পোল্ট্রি মুরগি রাখার জায়গা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ জনস্বাস্থ্যের জন্যও উদ্বেগের। ১০টি এলবিএম এবং ৫০টি আউটলেটে পরিচালিত উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, গাড়িতে পরিবহন এবং গাড়ি থেকে হাতে-হাতে খালাস ও দোকানে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবহেলা করা হয়ে থাকে। গবেষণায় জনাকীর্ণ খাঁচাভিত্তিক লেয়ারেজ সিস্টেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে, যেখানে থাকার স্থান, খাদ্য এবং পানীয় জলের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উঠে আসে। সমীক্ষাটি দেখায় ২২% আউটলেট বা দোকানে ব্রয়লার এবং সোনালি মুরগি আসার পরে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে খাবার বা পানীয় জল ছাড়াই থাকতে হয়, যার কারণে তাদের প্রাথমিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলো প্রায়শই অবহেলিত এবং ফলস্বরূপ দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাজারগুলোতে খাঁচায় বিক্রির জন্য ধারণক্ষমতার বাইরে একসঙ্গে অনেক মুরগি রাখা হলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাস, খাবার ও পানির সরবরাহ নিশ্চিতে অবহেলা দেখা যায়। মূলত যথাযথ প্রশিক্ষণ, মনিটরিং এবং প্রয়োগযোগ্য মানদণ্ডের অভাবে, বাজারের ব্যস্ততায় মুরগির প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এই সম্মিলিত চাপ মুরগির স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেমন, পানিশূন্যতা, দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং উচ্চ মৃত্যুহার। ছোট দোকানগুলোতে মৃত্যু হার বেশি, প্রধানত আবদ্ধ স্থান, অপর্যাপ্ত বায়ুচলাচল এবং অযত্নের কারণে। লাইভ বার্ড মার্কেটগুলোতে (খইগ) প্রাণী কল্যাণ ব্যবস্থার ঘাটতি নতুন নয়, পদ্ধতিগত ব্যবস্থা, অজ্ঞতা এবং বাজার মনিটরিং এর অনুপস্থিতিতে প্রায়শই প্রাণী কল্যাণ উপেক্ষা ও অবহেলা করা হয়, যার ফলে বিভিন্ন রোগ ও সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, বাজারগুলোতে জবাই করা মুরগি এবং তাদের বর্জ্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই বালতি বা পাত্রে রাখা হয়। এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ভোক্তাদের কেনা মুরগিতে ব্যাকটেরিয়ার দূষণের ঝুঁকি বাড়ায়। অধিকন্তু, মুরগি রাখার খাঁচা কয়েক দিন পর পর পরিষ্কার করা হলেও, খাঁচা এবং এর আশপাশে প্রায়শই দীর্ঘ সময় ধরে অপরিষ্কার থাকে। খামারগুলোতে, দীর্ঘ পরিবহনের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ও অসুস্থ মুরগি সময়মতো পানি ও খাবার না পেয়ে অন্যান্য মুরগির সংস্পর্শে সংক্রমণের ঝুঁকি ছড়িয়ে দিতে পারে। এই গবেষণায় প্রাণী কল্যাণ মানদণ্ড নিশ্চিত এবং বাজারের অনুশীলনের উন্নতির জন্য গুরুত্বারোপ করে। হাঁস-মুরগি সংবেদনশীল প্রাণী এবং তারা কেবল উৎপাদনের জন্য নয়, সহানুভূতিশীল আচরণেরও যোগ্য।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এর বিশিষ্ট গবেষক ও উল্লিখিত গবেষণা দলের প্রধান ড. মো. রিদোয়ান পাশা বলেন, পোল্ট্রি বাজারে মুরগিদের কল্যাণের প্রতি অবহেলা ও অসাবধানতা এত বেশি যে, বিক্রয় কার্যক্রমসহ খালাস থেকে জবাই পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পশুরা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হয়, তবুও স্বল্প সংখ্যক ক্রেতা এবং সচেতন ব্যক্তি এই গুরুতর বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।
যেহেতু প্রাণীদের পাঁচটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্ব মানুষের, তাই এলবিএমগুলোতে পোল্ট্রির প্রাণীকল্যাণও প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তবে, বাংলাদেশের বাজারগুলোতে মুরগির আবাসস্থল এবং জবাইয়ের সময় অসচেতনতা এবং উদাসীনতা যা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর, তা এখনো সঠিক সমাধানের অভাবে চলমান। ফলে মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতের পরিবর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকির শঙ্কা বাড়ছে। অতএব, পোল্ট্রি মুরগির কল্যাণে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো খুঁজে বের করার জন্য বাজারে বিদ্যমান পরিস্থিতি মনিটরিং করা প্রয়োজন। এর জন্য বিভিন্ন লালন-পালন পদ্ধতি যেমন- প্রতি মুরগিতে প্রতিপালন স্থান, মজুত ঘনত্ব, খাদ্য ও পানীয় জলের স্থান ও উৎস এবং সেইসঙ্গে জবাইয়ের পূর্বে মুরগিগুলোর সঠিকভাবে ধরা এবং জবাইয়ের সরঞ্জাম ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়া জরুরি। পরিচ্ছন্ন ও নিয়মতান্ত্রিক প্রটোকল অনুসরণই পারে পোল্ট্রি মুরগির রোগবালাই প্রতিরোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্যের পুষ্টি ও গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখা।
লেখক : গবেষক ও পরিবেশবিদ
প্যানেল/মো.