
ছবি: জনকণ্ঠ
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে যতজন প্রথিতযশা শিক্ষক শিক্ষকতা করেছেন, তাদের ভেতরে অন্যতম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীতে এই বিভাগ থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান-দুটি বিভাগ সৃষ্টি হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অন্যতম শিষ্য ছিলেন বুদ্ধিজীবী ও প্রথিতযশা লেখক আহমেদ ছফা। আহমেদ ছফা তার 'যদ্যপি আমার গুরু' বইতে তার গুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে লিখেছেন। ওই বইতে উল্লেখ আছে, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মন্তব্য করেন , ' আব্দুর রাজ্জাক একটি বিশ্ববিদ্যালয়।' যাহোক, ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহর মত পন্ডিত ব্যক্তি যখন কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করেন, তখন তার জ্ঞান মাপাটা কষ্টকর হয়- এটি নিশ্চিত!
'যদ্যপি আমার গুরু' বইতে আহমেদ ছফা লিখেছেন যে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন- কোন সমাজকে জানার জন্য সেই সমাজের মানুষ 'কি খায়' এবং 'কি পড়ে'- এটি জানতে। 'কি খায়' জানার জন্য বাজার ঘুরে দেখা জরুরি এবং 'কি পড়ে' দেখার জন্য লাইব্রেরী দেখা উচিত। অত্যন্ত দূরদর্শী পরামর্শ।
খাদ্যাভ্যাস একটি সমাজের আংশিক প্রতিচ্ছবি বটে। তাহলে বাকি অংশের প্রতিচ্ছবি পাঠ্যাভ্যাস। এটা কিভাবে?
পুস্তক বা অন্যান্য পাঠ্য সামগ্রীর জ্ঞান মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কেউ বিপ্লবের বই পড়লে সে বিপ্লবী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হবে, কেউ কবিতার বই পড়লে সে কাব্যিক ধারা দিয়ে প্রভাবিত হবে, কেউ ধর্মীয় বই পড়লে সে ধর্মীয় চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হবে আর কেউ বিজ্ঞানের বই পড়লে সে বিজ্ঞানের আলো দ্বারা আলোকিত হবে। যেহেতু শিক্ষা মানব জীবনের এমন এক প্রক্রিয়া যেটি দ্বারা মানবের আচরণ স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়, সেহেতু সে কি পড়ে -এটি তার আচার-আচরণ কথাবার্তা কাজকর্ম দ্বারা অবশ্যই প্রকাশিত হবে। আর সমাজ তো এই মানুষগুলোরই সম্মিলিত একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং পাঠ্যাভ্যাস একটি সমাজের প্রতিটি স্পন্দনকে নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি পড়ানো হচ্ছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে? নিশ্চয়ই বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী বা কিছু ক্ষেত্রে গবেষক তৈরি করার কারিকুলামে সংশ্লিষ্ট পাঠ পড়ানো হচ্ছে। পড়ানোর বিষয়গুলোকে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা অর্বাচীনের কাজ হবে। যে দেশ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডঃ মোঃ ইউনুসদের তৈরি করে, তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। তবে একটি সন্দেহ কখনো কখনো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে- বোধহয় সবার মনেই ওঠে, কেউ আমলে নেয়, কেউ আমলে নেয় না! প্রশ্নটি হচ্ছে, কখনো কখনো জাতির সম্পদ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণেরা কুরুচিকর শব্দ ব্যবহার করছে কেন; তাও আবার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নয় বা গুটি কয়েক বন্ধুর চায়ের আড্ডায় নয় বরং হাজারো তরুণের সম্মিলিত প্রতিবাদে, মিছিলের ভাষায়?
অশালীন ভাষা আর প্রান্তিক ভাষায় এক নয়।
৫২ থেকে ২৪। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই';
'বাঙালির মুখের ভাষা, বাংলাই হতে হবে'; 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো';
'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'; 'ডাউন ডাউন হাসিনা, এই স্বৈরাচার আর না'; 'গোলামি না আজাদী, আজাদী আজাদী'; দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা' ইত্যাদি স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেছে জাতির মেরুদন্ড এই ছাত্ররা। অর্জনের প্রমাণ হাতেনাতে। ৫২, ৭১, ৯০, ২৪- কোথায়ও ছাত্ররা বিফল হয়নি, ন্যায্য দাবি ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। এই বড় অর্জনগুলো বগলদাবা করতে কোথায়ও ছাত্রদের অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, বোধ করি রুচিও হয়নি। তাহলে হঠাৎ বিপ্লব ও প্রতিবাদের প্রয়োজনে, মিছিলের স্লোগানে সম্মিলিতভাবে কেন অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছে জাতির মেরুদন্ড এই ছাত্র সমাজ? কেন সেই স্লোগান ছাত্র সমাজ ব্যবহার করছে, যে স্লোগান বাবা তার সন্তানের সাথে দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারে না?
আমরা ঠিক পাঠ পড়ছি তো?
আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি না তো?
লেখক
এস এম নাহিদ হাসান
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
ফরিদপুর, পাবনা
মুমু ২