ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

যে শহর ভাসছে খুঁটির উপর

প্রকাশিত: ১৮:৫৬, ১৩ জুলাই ২০২৫

যে শহর ভাসছে খুঁটির উপর

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অধিকাংশ শহর যেখানে গড়ে উঠেছে মাটি, পাথর বা কনক্রিটের উপর, সেখানে ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহরগুলোর একটি ভেনিস দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ব্যতিক্রমী ভিত্তির উপর, হাজার বছর ধরে পানির নিচে গেঁথে রাখা কাঠের স্তম্ভের উপর। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটাই বাস্তবতা।

ভেনিস শুধু সৌন্দর্য বা ইতিহাসের জন্য নয়, একে বলা হয় মানব বুদ্ধিমত্তা ও প্রকৌশল কৌশলের এক জীবন্ত নিদর্শন। এ শহরের জন্ম হয়েছিল মানুষের বাঁচার এক মরিয়া প্রয়াস থেকে।


৪৫২ সালে রোমান সাম্রাজ্য পতনের মুখে। উত্তরের বর্বর যোদ্ধা হুনদের আক্রমণে ইতালির বহু সমৃদ্ধ শহর ধ্বংস হয়ে যায়। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা আশ্রয় নেয় এড্রিয়াটিক সাগরের তীরে ছোট ছোট দ্বীপে, যেগুলো ছিল কাদামাটি আর পানিতে ঘেরা—বাসযোগ্য তো নয়ই, এমনকি দাঁড়ানোরও উপযুক্ত নয়।

তবুও মানুষ হাল ছাড়েনি। টিকে থাকার দৃঢ় সংকল্প থেকেই শুরু হয় ভেনিস নির্মাণের কাজ। ক্রোয়েশিয়ার বন থেকে এনে বিশাল কাঠের স্তম্ভ কাদামাটির ভেতর পাথরের স্তরে পৌঁছানো পর্যন্ত ঠুকে বসানো হয়। হাজার হাজার স্তম্ভ পাশাপাশি বসানোয় কাদামাটি সরে গিয়ে তৈরি হয় এক মজবুত ভিত্তি।


অবাক করা ব্যাপার হলো, এই কাঠের স্তম্ভ পচেনি। কারণ পানির নিচে বাতাসের সংস্পর্শ না থাকায় কাঠে জীবাণু বাসা বাঁধতে পারেনি। এর উপর কাঠের তক্তা ও বিশেষ ধরনের চুন-সুরকি দিয়ে গড়ে তোলা হয় ঘর-বাড়ি। তারা সিমেন্টের বদলে ব্যবহার করে এমন এক ধরনের মোর্টার, যা মাটি কিছুটা নড়লেও ভাঙে না।
ভেনিশিয়ানরা জেনে গিয়েছিল ভারী ভবন বিপদ ডেকে আনবে। তাই তিনতলার বেশি ভবন বানায়নি কেউ। শহরে রাস্তা বা সেতু ছিল না; চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রিয়ালতো দ্বীপে পৌঁছাতে দরকার পড়ে সেতুর। প্রথমে কাঠের পন্টুন ব্রিজ বানানো হলেও এক ঝড়ে তা উড়ে যায়। পরে ১০,০০০ কাঠের স্তম্ভ ও ১২,০০০ পাথরের ব্লক ব্যবহার করে গড়ে ওঠে এক মজবুত সেতু—যা আজও ভেনিসের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে।


ভেনিসের আরেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সুপেয় পানির অভাব। চারপাশে লবণাক্ত পানি, নেই কোনো ঝরনা বা নদী। প্রথমদিকে পানি আনতে হতো মূল ভূখণ্ড থেকে, যা ছিল ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। পরবর্তীতে প্রকৌশলীরা তৈরি করেন বিশেষ জলাধার। গর্তে কাদামাটি, বালু ও পাথরের স্তর বসিয়ে তা পানির জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। ছাদের পানি প্রবাহিত হয়ে গর্তে জমা হতো, বালু-পাথর ছেকে তা বিশুদ্ধ হয়ে উঠতো। শহরজুড়ে ছিল প্রায় ৬০০ এমন কূপ—যা সে সময়ের এক অনন্য উদ্ভাবন।


প্রথমদিকে বাসাবাড়ির বর্জ্য জানালা দিয়ে খালে ফেলা হতো, যা শহরকে অস্বাস্থ্যকর করে তোলে। পরে ১৬ শতকে ভেনিশিয়ান প্রকৌশলীরা প্রতিটি বাড়ির নিচে সরু সুরঙ্গ বানিয়ে, তাতে বর্জ্য জমা করে, জোয়ারের সময় লবণাক্ত সমুদ্রপানি দিয়ে তা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেন। এতে যান্ত্রিক পাম্প ছাড়াই শহর হয়ে উঠতো জীবাণুমুক্ত ও দুর্গন্ধহীন।

 

 


আজও ভেনিস দাঁড়িয়ে আছে সেই হাজার বছরের পুরোনো কাঠের স্তম্ভের উপর। প্রতিটি ভবন, সেতু, খাল যেন সেই সময়ের মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, প্রকৌশল জ্ঞান এবং টিকে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও ভেনিস আমাদের শিখিয়ে দেয়, প্রযুক্তির চেয়ে বড় হচ্ছে মানুষের সংকল্প, আর সংকটের চেয়ে বড় শিক্ষক কিছুই নেই।

ছামিয়া

×