
ছবি: সংগৃহীত
নব্বইয়ের দশক—সময়ের এক অলিখিত কবিতা, যেন কোনো পুরনো ট্রাঙ্কে ভরে রাখা শৈশবের গন্ধমাখা চিঠি। এই দশক ছিল না কোনো ভার্চুয়াল বিভ্রমে বাঁধা, ছিল না সোশ্যাল মিডিয়ার কৃত্রিম ভিড়। ছিল কেবল মানুষ, ছিল মাটি, আর ছিল মনের মতো করে গড়া এক রঙিন বাংলাদেশ।
সেই সময় টেলিভিশন ছিল ঘরের ঈর্ষণীয় সম্পদ। একটি সাদা-কালো বাক্স আর তার সামনে বসা দশ-পনেরো মুখ—চোখেমুখে বিস্ময় আর আগ্রহের আলো। দুপুরবেলা নাটক, সন্ধ্যায় ‘ইত্যাদি’, আর ছুটির সকালে কার্টুন—সেই সময়ের বিনোদন ছিল সরল, কিন্তু মুগ্ধতার চূড়ায়।
পাড়ার মাঠে ছিল খেলার রাজ্য—লাটিম ঘোরানো, দাড়িয়া বান্ধা, মার্বেল খেলা, কুমিরডাঙ্গা, সাতচাড়া কিংবা বোম্বাস্টিং। প্লাস্টিকের সৈন্য, কাঁচের মার্বেল, গুলতির নিশানা—সবকিছুতে ছিল এক অমলিন আনন্দ। বন্ধুদের সঙ্গে টায়ার নিয়ে দৌড়, ভিজে মাঠে হাডুডু, আর খেজুর পাতার চশমা পরে ‘বড়’ হবার অভিনয়—এসব ছিল জীবনের অমূল্য ধন।
শিশির ভেজা সকালে পত্রিকা হাতে বাবার প্রতীক্ষা, চুলার পাশে বসে মায়ের হাতে সেদ্ধ আলু খাওয়ার মতো শান্তি—আজও যেন সেই মুহূর্তগুলো বুকের ভেতর নিঃশব্দে কাঁপে।
চরুই ভাতি ছিল এক সামাজিক উৎসব—বাড়ি বাড়ি ঘুরে উপকরণ জোগাড়, আর তারপর বড় কড়াইয়ে রান্না হওয়া সেই ভাত যেন স্বাদে ছিল সবার উপরে। আর ছিল মাটির ব্যাংক—টাকাজমানোর প্রথম পাঠ, প্রথম স্বপ্ন।
বৃষ্টির দিনে কাগজের নৌকা ভাসানো, সাইকেল চালিয়ে পাড়ার পর পাড়া ঘোরা, কিংবা ভিউমাস্টার চোখে লাগিয়ে অন্য এক জগতে হারিয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে সময়টা ছিল একধরনের যাদুকরী বাস্তব।
আরও কত কিছু—টাইগার বাম, কলম, লজেন্স, মিমি চকলেট, সাদ্দামের গুলি, প্লাস্টিকের আংটি, কাঠের র্যাকেট, কটকটি, ঢাকনার ঢাক, পানের কৌটা, হ্যান্ড পাম্পের ঠাণ্ডা জল—সবই যেন এক একটা ছোট ছোট কবিতা হয়ে হৃদয়ে গেঁথে গেছে।
চিঠির দিনে ভালোবাসা ছিল অক্ষরে বাঁধা, আর হাওয়াই মিঠাই ছিল এক রঙিন স্বপ্ন। সিঁড়ির ধাপে বসে সোনালী রোদে সুরোধ খাওয়ার যে আনন্দ, তা আজকের ডিজিটাল জগতে খুঁজে পাওয়া দায়।
রাতের আকাশে ঝুলে থাকা চাঁদকে আমরা ভাবতাম মামা—আর সেই আলোতে বসে গল্প, আড্ডা, গান চলত গভীর রাত অবধি।
আজ যখন চারপাশে প্রযুক্তির চটচটে উজ্জ্বলতা, তখন হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় সেই ফিকে আলোয় মোড়া সুন্দর দিনগুলোর কথা।
যে দিনগুলোতে জীবন ছিল ধীর, সরল, আর হৃদয়ভরা।
আজও যখন ক্লান্ত বিকেলে মন বলে ওঠে—
"কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…"
তখন বুকের গভীরে এক অদ্ভুত কষ্ট-সুখ মিশে গিয়ে ফেলে আনে একফোঁটা চুপচাপ স্মৃতির জল।
শেখ ফরিদ