ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

শ্রমিকদের খাবার থেকে যেভাবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পিজ্জা

ইসমাইল হোসেন স্বপন, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ইতালি 

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫

শ্রমিকদের খাবার থেকে যেভাবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পিজ্জা

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় পিজ্জা নামটি যেন অনায়াসেই জায়গা করে নেয়। তবে এই পিজ্জার জন্ম কোন দেশে? কোথা থেকে এলো এই খাবারের প্রচলন, তার ইতিহাসই বা আমরা ক'জন জানি?

পিজ্জার ইতিহাস একেবারে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার এক অনন্য উদাহরণ। ১৮ শতকের শেষ দিকে ইতালির বন্দরনগরী ন্যাপলস ছিল গরিব শ্রমজীবী মানুষের শহর। কাজের ব্যস্ততায় তারা চাইত এমন এক খাবার যা সস্তা, দ্রুত প্রস্তুত হয় এবং সহজে খাওয়া যায়।

শ্রমিকদের প্রয়োজনে ময়দার পাতলা রুটির উপর টমেটো, রসুন, অলিভ অয়েল ও স্থানীয় চিজ দিয়ে তৈরি হতো পিজ্জা। সে সময় সমাজের উচ্চবিত্তরা এই খাবারকে নিচু দৃষ্টিতে দেখতেন।

ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় ১৮৮৯ সালে। ইতালির রানি মার্গারিটা ন্যাপলস সফরের সময় পিজ্জার স্বাদ নিয়ে মুগ্ধ হন। তাঁর সম্মানে তৈরি করা হয় “পিজ্জা মার্গারিটা”। পিজ্জায় টমেটোর লাল, মোজারেলার সাদা এবং বাসিল পাতার সবুজ রঙে ফুটে ওঠে ইতালির জাতীয় পতাকার ছায়া। রাণী এই পিজ্জার স্বাদে এতটাই মুগ্ধ হন যে, এটি তখন থেকেই রাজকীয় স্বীকৃতি পায় এবং ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সবার প্রিয়।

এরপর অভিবাসনের ঢেউ, বিশেষ করে ইতালিয়ানরা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর সঙ্গে সঙ্গেই পিজ্জাও পারি দেয় আটলান্টিকের ওপারে। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় গড়ে ওঠে পিজ্জার দোকান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যরা পিজ্জার স্বাদ নিয়ে ফিরে গিয়ে নিজ দেশে এই খাবারের প্রসার ঘটায়।

বর্তমানে, ইতালির প্রতিটি শহর ও অঞ্চলে রয়েছে পিজ্জার নিজস্ব ধরণ। রোমের পাতলা ও ক্রিস্পি পিজ্জা, সিসিলির মোটা ও ঘন ডো-এর পিজ্জা কিংবা মিলানের ফিউশন পিজ্জা—সবকিছুতেই রয়েছে স্থানীয় উপাদান ও নিজস্ব স্বাদের ছোঁয়া।

আন্তর্জাতিকভাবেও ইতালির এই খাবারটি আজ এক অনন্য পরিচিতি পেয়েছে। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে ন্যাপলসের ঐতিহ্যবাহী পিজ্জা তৈরির পদ্ধতিকে "Intangible Cultural Heritage" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পিজ্জা তৈরি করেন যারা, তাদেরকে বলা হয় "Pizzaiuolo"—এটি একটি সম্মানজনক পেশা ইতালিতে।

প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ইতালির নানা শহরে এসে এই ঐতিহ্যবাহী পিজ্জার স্বাদ নিতে ভিড় করেন। ভেনিসের একটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের মালিক মারিও কান্তারে বলেন, “পিজ্জা এখানে শুধু খাবার নয়, এটি আমাদের আত্মার অংশ। প্রতিটি ডো বানানো হয় যত্নে, ভালোবাসায় এবং ২০০ বছরের ঐতিহ্য মেনে।”

বর্তমানে প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বজুড়ে পিজ্জা নানা রূপে পরিবেশিত হলেও ন্যাপলসের কাঠের চুলায় তৈরি পিজ্জা মার্গারিটার স্বাদ এখনও অনন্য। 

বিশ্বের নানা প্রান্তে যখন নানা ব্র্যান্ড পিজ্জার বৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে, তখনও ইতালির পুরোনো রেস্তোরাঁগুলোতে পিজ্জা তৈরি হয় আদি প্রচলিত নিয়ম মেনেই। যেন শত বছর আগের সেই ঐতিহ্য এখনো জীবন্ত। ইতালির পিজ্জার সেই স্বাদ-ঘ্রাণ পেতে হলে একবার হলেও পাড়ি জমাতে হয় ইতালির রাস্তায়, ন্যাপলসের অলিতে-গলিতে।

প্রতিদিন পৃথিবীতে কয়েক কোটি মানুষ যে খাবার খায়, তা কোনো একদিন ছিল ন্যাপলসের গলির সাধারণ লোকদের দুপুরের খাবার। সেই শ্রমিকদের রুটি-চিজের সহজ খাবারই বিলিয়ন ডলারের ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে আজ।
 

নোভা

×