ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

মুঘল আমলের খাগড়া খান বাড়ি মসজিদ: চারশ বছরের ঐতিহ্য বয়ে চলেছে

সাফিজল হক তানভীর, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শেরপুর

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ১২ জুলাই ২০২৫

মুঘল আমলের খাগড়া খান বাড়ি মসজিদ: চারশ বছরের ঐতিহ্য বয়ে চলেছে

শেরপুর জেলার সীমান্তঘেঁষা ঝিনাইগাতি উপজেলার ঘাঘড়া লস্কর গ্রামে অবস্থিত ‘খাগড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদটি মুঘল আমলের এক স্থাপত্য নিদর্শন, যা নির্মিত হয় ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ হিজরি ১০২৮ সনে। মসজিদটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত স্থাপনার তালিকায় রয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই মসজিদটির স্থাপত্যে ফুটে উঠেছে মুঘল আমলের নির্মাণশৈলী ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা। একটি এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকার ভবনের মাঝখানে প্রধান গম্বুজ, আর চারকোনায় চারটি মিনারসহ রয়েছে মোট ১২টি ছোট-বড় মিনার। প্রায় ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থবিশিষ্ট ভবনটির দেয়াল প্রায় ৪ ফুট পুরু এবং নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে চুন, সুরকি ও ইট। দেয়ালের বাইরের অংশে দেখা যায় ফুল, ফুলদানি ও লতাপাতা খচিত কারুকাজ, যা এই স্থাপনাটিকে আরও শৈল্পিক করেছে।
মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে একমাত্র প্রবেশপথ। ভেতরে রয়েছে দুটি খিলান এবং একটি অলংকৃত মেহরাব। অভ্যন্তরে প্রায় ৩০–৩২ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন, আর বারান্দাসহ বাইরের অংশে আরও শতাধিক মুসল্লি নামাজে অংশ নিতে পারেন।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন খান পরিবারের পূর্বপুরুষরা, যাঁরা মুঘল শাসনামলে এই এলাকায় প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতেন। এই মসজিদ ঘিরে খান বাড়ি পরিবার ও এলাকাবাসীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে উঠেছে। প্রায় ৫৮ শতাংশ জমি মসজিদের জন্য ওয়াক্ফ করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল মসজিদ ও বারান্দা ঘিরে রয়েছে ১৭ শতাংশ জমি এবং আশেপাশে প্রায় ৪১ শতাংশ জমিতে রয়েছে কবরস্থান।

প্রতিদিন এলাকার মুসল্লিরা এখানে জামাতে নামাজ আদায় করেন। শুক্রবার ও ঈদে এ মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি আশেপাশের এলাকা থেকে অনেকে ওয়াক্ফ এই স্থাপনাটি দেখতে আসেন।

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, এটি শুধু ধর্মীয় উপাসনার স্থান নয়, আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য। শতাব্দী পেরিয়ে আজও টিকে আছে এটি, আমরা এটাকে গর্ব হিসেবে দেখি।

মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসার পর থেকে মসজিদের কিছুটা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হলেও এখনো ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা চান, মসজিদটির সৌন্দর্য ও গৌরব ধরে রাখতে আরও পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হোক।

ঝিনাইগাতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)  মোঃ আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা স্থানীয়ভাবে এর পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের সুবিধা বাড়াতে সহায়তা করছি।

ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে ‘খাগড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। মুঘল আমলের নির্মাণশৈলী, স্থায়িত্ব এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য বহনের দিক দিয়ে এটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

চার শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এই মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রচার করা গেলে এটি হতে পারে শেরপুর জেলার অন্যতম দর্শনীয় ও গৌরবময় স্থান।

Mily

×