
শিল্পীর কল্পনায় ঈশা খাঁ ও মানসিংহের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ছবি: সংগৃহীত
১৫৯৬ সালের কথা। বাংলার বীর যোদ্ধা ও বারো ভূঁইয়ার অন্যতম নেতা ঈশা খাঁর সঙ্গে সম্রাট আকবরের প্রেরিত সেনাপতি রাজা মানসিংহের এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের মাঠ ছিল আজকের ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার টাঙ্গাব গ্রাম। এ যুদ্ধ শুধু রণকৌশল নয়, দুজন বীরপুরুষের মহানুভবতার এক বিরল উদাহরণ হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
ঈশা খাঁর অনুপস্থিতিতে মানসিংহ তার দুর্গ এগারসিন্দুরে আক্রমণ চালান। সংবাদ পেয়ে ঈশা খাঁ দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন, কিন্তু তার সৈন্যরা তখন এতটাই ক্লান্ত ছিল যে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাধ্য হয়ে ঈশা খাঁ রাজা মানসিংহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ জানান। মানসিংহ এই প্রস্তাবে রাজি হন।
প্রথম দিন মানসিংহ নিজে না এসে তার জামাতাকে পাঠান। কিন্তু ঈশা খাঁ তাকে চিনে ফেলেন এবং যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর মানসিংহ নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন। শুরু হয় ভয়ঙ্কর লড়াই। একপর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ তাকে মারার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আঘাত না করে নিজের তরবারি এগিয়ে দেন। কিন্তু মানসিংহ তরবারি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন।
ঈশা খাঁ তখন তাকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানান। মানসিংহ তা গ্রহণ না করে ঈশা খাঁকে আলিঙ্গন করেন। এই বীরত্ব, সাহস ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ঈশা খাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
পরে মানসিংহের স্ত্রী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, পরাজিত মানসিংহকে সম্রাট আকবর হয়তোবা মৃত্যুদণ্ড দেবেন। এবারও এগিয়ে আসেন ঈশা খাঁ। তিনি স্বেচ্ছায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানসিংহের সাথে সম্রাট আকবরের দরবারে যান। সেখানে শুরুতে ঈশা খাঁকে বন্দি করা হলেও মানসিংহ পুরো ঘটনা খুলে বললে সম্রাট আকবর ঈশা খাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে ২২টি পরগনার শাসনাধিকার দেন এবং “মসনদ-ই-আলা” উপাধিতে ভূষিত করে স্বদেশে ফিরিয়ে দেন।
ঈশা খাঁর জন্ম হয়েছিল গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে ১৫৩৬ সালের কাছাকাছি সময়ে। শৈশবে তিনি ও তার ভাই ইসমাইল খাঁ ক্রীতদাস হিসেবে তুরানে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন। পরে কররানী শাসক তাজ খাঁর অধীনে থাকা তার মামা তাদের বাংলায় ফিরিয়ে আনেন। এরপর ঈশা খাঁ নিজেকে তৈরি করেন একজন বীর ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে।
ঐতিহাসিক এই যুদ্ধক্ষেত্রটি আজও আছে গফরগাঁওয়ের টাঙ্গাব গ্রামে। তবে দুঃখজনকভাবে ৪০০ বছরের পুরনো এই ইতিহাস আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। ১৬ একর খাস জমির মধ্যে বসতবাড়ি ও ফসল চাষের অজুহাতে জায়গাটি দখল হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগণের দাবি, সরকার যেন এই ঐতিহাসিক স্থানকে সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে।
বারো ভূঁইয়া নামক সংগঠনের নেতা ছিলেন ঈশা খাঁ। তারা মূলত বাংলার স্বাধীনতাকামী স্থানীয় জমিদার ও নেতা ছিলেন, যারা মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। যদিও সংখ্যায় তারা ১২ জনের বেশি ছিলেন, তবুও ‘বারো ভূঁইয়া’ নামেই তারা ইতিহাসে পরিচিত।
আজ ঈশা খাঁর উদারতা, সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম আমাদের জন্য এক গর্বের অধ্যায়। তার মতো বীরদের স্মৃতি রক্ষায় আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
এম.কে.