ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

পাল তুলে বর্ষার আকাশে ভাসে সুরের ‘রংধনু

শেখ আব্দুল আওয়াল, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ০২:১২, ১০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০২:১৮, ১০ জুলাই ২০২৫

পাল তুলে বর্ষার আকাশে ভাসে সুরের ‘রংধনু

ছবি: জনকণ্ঠ

মেঘ মাদলের পাল তুলে এসেছে বর্ষার সুরের তরী। অবারিত বারিধারায় এই তরী রোমান্টিকতা ও মধুর বেদনাও এনেছে। বর্ষার জলীয়বাষ্পে সোমবার আকাশের  আরেকদিকে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণে মাঝে মধ্যে ভেসে উঠছে ছন্দের রংধনু। কেউ বলে রামধনু, কেউ ইন্দ্রধনু। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের পালায় রংধনু খেই হারিয়ে ফেলছে। বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে আকাশে চোখ মেলবে। মেঘ তো পালা করেই আসছে। মেঘের এই খেলায় তাল মেলাতে পারছে না রংধনু। বাংলার ঋতু বৈচিত্র বর্ষাকালের কতই না ব্যঞ্জনা...। 

বাল্মীকী থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বর্ষার আবেদন এসেছে নানা বর্ণনায়। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই বর্ষাকে ঘিরে প্রকৃতিতে মানব মানবীর হৃদয়ের যে ছবি এঁকেছেন তা আর কেউ পারেননি। বর্ষায় আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানান বর্ণিল মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের উল্টো পাড়েই রংধনু। মেঘ বৃষ্টি রংধনু নিয়ে বাঙালীর বর্ষার জীবন প্রবাহ। আছে কত গান কত কবিতা। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু.....’ সুরে রোমান্টিকতার আবেশ। 

রিমঝিম শব্দের বৃষ্টি হৃদয়ে আনে মধুময় ছন্দ। এর মধ্যেই মেঘ কিছুটা সরে গিয়ে আকাশের কোণে জায়গা করে দেয় রংধনুকে। সাত রঙা রংধনুতে সাত রং মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হৃদয়ের বর্ণিল রং ফুটে উঠে। মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চন্ডীদাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে মিলিয়েছেন কাব্য। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে গিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে। সেই ধারাতেই হয়তো এসেছে রংধনু। মেঘলা দিনে আকাশজুড়ে আঁকা রংধনু নিয়ে আছে কতই না কথা! রংধনুর কয়টি রং তা নিয়েও বিতর্ক আদিকালের। বিজ্ঞান বলছে, ধনু আকৃতির আলোর রেখা রংধনু। বায়ুম-লে জলকণায় সূর্যালোকের প্রতিফলন প্রতিসরণের ফলে সৃষ্টি রংধনু ধনুকের মতো বাঁকা। নেতিয়ে পড়ে আকাশে। রংধনু ও আকাশের আছে সখ্য। যদিও অল্প সময় দৃশ্যমান থাকে আকাশে। 

সাধারণত বৃষ্টির পর আকাশে সূর্যের বিপরীত দিকে দেখা যায় রংধনু। বৃষ্টি জলীয় বাষ্পের কণার সংস্পর্শে আলোর প্রতিসরণে সৃষ্টি হয় বর্ণালী। বর্ণালী ভাগ হয় সাত রঙে। বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল (বেনীআসহকলা)। প্রতিটি রঙের ইংরেজী আদ্যাক্ষর দিয়ে রংধনুর রংগুলোকে এক সঙ্গে বলা হয় ‘ভিবজিওর’ (VIBGYOR)। ভিন্ন সাতটি রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘের কারণে বেঁকে যাওয়ার তারতম্য ঘটে। যেমন লাল রঙের আলোকরশ্মি ৪২ ডিগ্রী কোণে বাঁকা, বেগুনি ৪০ ডিগ্রী কোণে বাঁকা, বাকি রংগুলো ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রী কোণের মধ্যে বাঁকা থাকে। রংগুলো নির্দিষ্ট সারিতে সব সময় থাকে না। সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রংধনুর ওপর দিকে কম উজ্জ্বল এবং আরেকটি গৌণ রংধনু বিপরীত পরিক্রমে থাকে। দুই রংধনুর মধ্যবর্তী গাঢ় অঞ্চল ক্ষণিকের জন্য দৃশ্যমান হলে হৃদয় বর্ণিল হয়ে ওঠে।

রংধনুর এই তত্ত্বে বাদসাধাসাধি শুরু গ্রীকের পুরাণ যুগে। মহাকবি হোমার বলেছেন, রংধনুর রং একটিই। দৃষ্টিভ্রমে তা অনেক রং দেখায়। দার্শনিক জোনাদিনের ভাষায়, হলুদ সবুজ লাল রংধনুর এই তিনটি রং। এরিস্টটল এ যুক্তি সমর্থন করেন। তবে নিউটন জানান দেন রংধনুর রং পাঁচটি। তারপর অবশ্য এই নিউটনই বলেন রংধনুর সাত রং। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা রংধনুর নিউটনের কথায় সাত রঙের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেন। তারা তিন ধরনের রংধনুর বর্ণনা দেন।

রংধনু গ্রীক পুরাণ থেকে চীনের প্রাচীন তত্ত্বে নানারূপে উপস্থাপিত হয়েছে। দেশে দেশে শিল্পীরা রংধনু নিয়ে ছবি এঁকেছেন, শিল্পী গান গেয়েছেন কবি কবিতা লিখেছেন। বর্ষার এই রংধনু কি হারিয়ে যাচ্ছে! গত ক’বছরে বর্ষায় বৃষ্টি ছিল কম। রংধনুও চোখে তেমন পড়েনি। এবারের বর্ষায় বৃষ্টি বেড়েছে। তারপরও আকাশে রংধনুর দেখা মিলছে না। 

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষায় যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকার কথা তা নেই। যে কারণে বৃষ্টি বাড়লেও গরম কমছে না। আর্দ্রতার হেরফেরে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা প্রভাব উর্ধাকাশে পড়েছে। যে কারণে রংধনু সৃষ্টি হতে গিয়েও কোথায় যেন বাধা পাচ্ছে। তবে রংধনু একেবারেই সৃষ্টি হচ্ছে না এমনটিও নয়। হয়তো রংধনু সৃষ্টি হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কে আর এখন বৃষ্টির পর আকাশপানে চেয়ে থাকে! গ্রামে হয়তো রংধনু চোখে পড়ে। অস্থিরতার মধ্যে কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকা শহরে রংধনু কখন উঠল, কখন মিলিয়ে গেল তার খোঁজ কে রাখে! অতীতে আকাশে রংধনু দেখা দিলে তা দেখতে উৎসাহের কমতি ছিল না। 

রংধনু আকাশ কিছুক্ষণের জন্য সাজায়। কাব্যিক মনে নানান কথামালার সৃষ্টি হয়। বর্ষার এমন রূপ বাংলার আকাশে যেভাবেই আসুক তার সত্তা ঘিরে আছে বাস্তবতায় মানব-মানবীর জেগে ওঠার সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান।

শহীদ

×