
ছবি: সংগৃহীত
কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারই যে মানুষের একতাবদ্ধ হওয়া সহ্য করতে পারেনা, সবকিছুতেই যে ফ্যাসিস্টরা অবৈধভাবে নিজেদের আকঁড়ে রাখা ক্ষমতা হারানোর আশংকায় ভীত থাকে তারই প্রমাণ মেলে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মাঝে।
আর এ কারণেই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবিতে আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখিয়ে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়। ছাত্রলীগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলে তালাবদ্ধ করে রাখার অপচেষ্টা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করানো হয়। তবে এসব অপকৌশল শুধু যে, ব্যর্থ হয় তাই নয় উল্টো শিক্ষার্থীদের আরও বেশি বিক্ষুব্ধও করে তোলে।
এরই ধারাবাহিকতায় সরাসরি পুলিশকে ব্যবহার করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর আঘাত ও যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। অজুহাত হলো শাহবাগে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নেওয়া। অন্যদিকে এদিন আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের বেশ সরব দেখা যায়। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে পরামর্শ দিতে থাকে যে, 'এখন আন্দোলন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরা উচিত'।
তবে অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুবরা ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুলিশের মামলা প্রত্যাহার এবং কোটাবৈষম্য নিরসনে সংসদে আইন পাসের লক্ষ্যে জরুরি অধিবেশন আহ্বানের দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৩ জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন পরের দিন, বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে গণপদযাত্রা শুরু হয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।
গণপদযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, নজরুল ইসলাম কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবেন বলেও জানানো হয়। আর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ নিজ পদযাত্রা নিয়ে একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেবে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, চলমান বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিকে জনভোগান্তির কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, যদি প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারেন, তাহলে একটি সন্তানবিবর্জিত পৃথিবী হবে। সুতরাং, সুন্দর পৃথিবীর জন্য সাময়িক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।'
মামলার বিষয়ে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছিলেন, কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। তাহলে হঠাৎ অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দেওয়া হলো কেন, সে বিষয়ে আমরা জবাবদিহি চাইছি। ছাত্রসমাজকে এ রকম মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন নাহিদ ইসলাম।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার পুলিশের রমনা জোনের এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমাদের সাঁজোয়া যান ছিল, শিক্ষার্থীরা তার পাশে দাঁড়িয়ে নাড়িয়ে ছবি তুলেছে। এখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।
অথচ এর পরেরদিন সরকারি কাজে বাধা, পুলিশ সদস্যদের ওপর আঘাত ও যানবাহনের ক্ষতি করার অভিযোগে শুক্রবার মামলা দায়ের হয়। এতে আসামির সংখ্যা ও নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
এজাহারে বলা হয়, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে অজ্ঞাতনামা ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিভিন্ন হলে ঘুরে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে শাহবাগ মোড়ের দিকে আসে। একপর্যায়ে তারা শাহবাগ মোড় অতিক্রম করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে এবং সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি ও এলোপাতাড়ি মারধর করে।
এজাহারে আরও বলা হয়, সেদিন দুটি যানের প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
এদিন, ছাত্রদের আন্দোলন থামানো উচিত বলে বক্তব্য দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, জনদুর্ভোগ মেনে নেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না ফিরলে তাদের ঘরে ও ক্লাসে ফেরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকার।
আরও এক ধাপ বাড়িয়ে এদিন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ক্ষমতা, আমরা সেটাই করব। তিনি আরও বলেন, আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে কিনা, ঘটনাটি অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টা চলছে কিনা-এসব নিয়ে ডিবির টিম ও পুলিশ কাজ করছে।
১৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যু নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা সংগ্রহ, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করার জন্য 'পলিসি অ্যাডভোকেসি' ও 'ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন' শুরু করে।
এসময় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সভাপতি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেশাদার আন্দোলনকারীরা হিসেবে অভিহিত করে বলে, এরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য রাজপথে রয়েছে।
তবে এমন কর্মসূচিকে আন্দোলন দমনের পাল্টা কর্মসূচি বলেই মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অন্যতম সমন্বয়ক বাকের মজুমদার জানান, শিক্ষার্থীরা যেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিতে না পারেন, সেজন্য একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে কর্মসূচি দিয়ে রাখে ছাত্রলীগ। সেখানে অংশ না নিলে রাতে সেই শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ছাত্রলীগের পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এদিন, দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। দুপুরে প্রক্টরের সঙ্গে দেখা করার পর কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান সেখানকার নেতারা। তবে অন্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া শুরু করলে মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় প্রশাসনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বের হতে নিষেধ করা হয়।
অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালসহ সাত দফা দাবিতে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন ও প্রজণা ৭১-এর সভাপতি আজিজুর রহমান।
ফারুক