ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

জাতীয় ঐকমত্যের জন্য ইসলাম, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ- এই চার রাষ্ট্র পরিচালনার সাংবিধানিক মূলনীতির মধ্যে গণভোট জরুরি

মোহাম্মদ আজিজুল হক

প্রকাশিত: ১৭:৩৬, ১৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:৩৮, ১৩ জুলাই ২০২৫

জাতীয় ঐকমত্যের জন্য ইসলাম, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ- এই চার রাষ্ট্র পরিচালনার সাংবিধানিক মূলনীতির মধ্যে গণভোট জরুরি

বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা/অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে এ মুহূর্তে ইসলামকে সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা আবশ্যক, যে কারণে (Rationale):

১) ইসলাম ও সেকুলারিজমের মধ্যে গণভোট হলে নিশ্চয়ই ইসলাম জয়ী হবে। তাহলে গণভোট ছাড়া পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকানো সেকুলারিজম সংবিধানে থাকতে পারলে বিপুলভাবে জননন্দিত ইসলাম কেন থাকতে পারবে না? ইসলামের মতো একটি জনপ্রিয় তত্ত্বের প্রতি এত শত্রুতা, বিদ্বেষ কেন??? ইসলাম কি কারো পাকা ধানে মই দিয়েছে? ইসলাম তো এ অঞ্চলের মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। জনগণের ভোট বা সমর্থনে যেটা জয়ী হয়, তারই তো থাকা উচিত। অন্যগুলো তো থাকা উচিত না, কারণ সেগুলো জনগণের দ্বারা ভোটে প্রত্যাখ্যাত। সুতরাং আমাদের উচিত জনগণের ইচ্ছাকে রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্রে প্রতিফলিত করার ব্যবস্থা করা, কারণ সংবিধান বা গঠনতন্ত্র হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার ফলশ্রুতি। কেউ হয়তো বলবে ২০২৪ সালের এই বিপ্লব কি ইসলামের জন্য হয়েছে? এই প্রশ্ন যারা করে, তারা মূলত সংবিধানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চায় না। তাদেরকে প্রশ্ন করি, এ বিপ্লব কি ইসলামের বিরুদ্ধে হয়েছে?? এ বিপ্লব কি সেকুলারিজম বা সোশ্যালিজম নামক পচে যাওয়া মতবাদের জন্য হয়েছে? এগুলো সংবিধানে রাখতে চান কিভাবে? যতক্ষণ পর্যন্ত সংবিধানে ইসলাম না আসছে, এ দেশের মানুষ সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত ঝরাতেই থাকবে, কারণ ইসলাম এ দেশের গঠনতন্ত্রে মৌলনীতি হবার জন্য জন্মলগ্ন থেকে overdue হয়ে রয়েছে। এ তত্ত্বকে গঠনতন্ত্রে না আনা ইসলাম ও জনগণের উপর একটা জুলুম। কথা হলো, আর কত বিপ্লব হলে, আর কত লক্ষ মানুষের রক্ত ঝরিয়ে সংবিধানে ইসলাম আনতে চান সংস্কারকরা?? জনগণের এখনকার বিপ্লব কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সুযোগ হয়ে আসেনি?

২) সেকুলারিজম ভারত থেকে আমদানিকৃত, সোশ্যালিজম চীন ও রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত, গণতন্ত্র আমেরিকা ও ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত। এগুলো সবই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি দিয়ে আবার সংবিধানকে জনগণের ইচ্ছার ফলশ্রুতি বলার চাইতে বড় ভণ্ডামি আর কি হতে পারে? আমি মনে করি, ৯০% মুসলমানের দেশে ইসলামহীন সংবিধান একটি বিভাজনের সংবিধান। জনগণের সাথে এ ধরনের প্রতারণা করে সে সংবিধানকে গণতান্ত্রিক বা জনগণের সংবিধান বলা, আর সে সংবিধান দিয়ে দেশকে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করা অলীক কল্পনা আর তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। তাহলে দেশের নিজস্ব রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কোনটা? সংবিধানে দেশের আদর্শ না রেখে, কিভাবে সে সংবিধানে দেশ চলে? এ সংবিধান কতটুকু শান্তি আনতে পারবে??? মূলত দেশের ৯০% মানুষ যে আদর্শে বিশ্বাস করে (৯০% মানুষের মধ্যে সবাই হয়তো ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে বোঝে না, কিন্তু সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থই ম্যাক্সিমাম মানুষ জানে না, আর তা চর্চা তো বহু দূর), সেটা ইসলাম। আর সে ইসলামের মাধ্যমেই এই দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। ইসলাম ছাড়া আপাতত অন্য কোনো আদর্শই এ দেশে নেই, যেটি দিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব।

৩) বাংলাদেশে ইসলাম ছাড়া এমন কোনো জীবনাচার আছে, এমন কোনো দর্শন আছে যেটি বাংলাদেশের ৯০% মানুষ প্রত্যহ চর্চা করে? ইসলাম ছাড়া সেরকম কোনো দর্শনই পাবেন না। সেকুলারিজম ও সেকুলার এলিট শ্রেণি হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতের সফট পাওয়ার। ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা থাকলে, ভারত সফট পাওয়ারের হাত ধরে কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফ্যাসিজম সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়ে যাবে, এক্ষেত্রে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হবে না। বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সাথে ফ্যাসিজম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারতীয় আধিপত্যবাদের ভিত্তি সেকুলারিজম, যা বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-বিশ্বাস-ইচ্ছা, অর্থাৎ গণআকাঙ্ক্ষার বিপরীত। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা তত্ত্বটি সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগুরু, এবং সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘু বানানোর এক মহা জুলুমের তাত্ত্বিক মেশিন। জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শাসন করতে গেলে তো ফ্যাসিবাদী হতেই হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা আর ফ্যাসিবাদ সমার্থক হয়ে গেছে। সুতরাং ভারতীয় বা বিদেশি আধিপত্য থেকে বের হতে হলে ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে চাইলে অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে চিরতরে বিদায় করতে হবে, সে জায়গায় ইসলামকে বসাতে হবে।
সবার মিলেমিশে যার যার ধর্ম পালন করবে—ধর্মনিরপেক্ষতার এমন অর্থ দিয়েও এটাকে রাখা যাবে না, কারণ মিলেমিশে যার যার ধর্ম পালন করা তো ধর্মীয় সম্প্রীতিকে বোঝায়, সেটা তো ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার এমন অর্থ দেওয়া জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি করা ছাড়া কিছুই নয়। এটা হল গণপ্রত্যাখ্যাত ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাখার জন্য জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করার অপপ্রয়াস।

৪) প্রথমত, ধর্মকে যদি আমি রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বাদ দেই, তাহলে যেটা থাকে সেটা হচ্ছে "যা ইচ্ছা তা করা"র নীতি। আর সেটা চরম বিশৃঙ্খলা ও ফ্যাসিবাদ ছাড়া কিছুই নয়। যা ইচ্ছা তা করা গেলে তো রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ কিছুই থাকে না। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব সৃষ্টির নামই ফ্যাসিবাদ। আর মানুষের উপর স্রষ্টার প্রভুত্ব সৃষ্টির নামই ধর্ম।
ধর্ম যদি আনি, তাহলে এ দেশে কী আসবে? এ দেশের অধিকাংশ মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য বা প্রতিনিধিত্বশীল যে ধর্ম, সে ইসলাম ধর্মকেই আনা যায়। অন্য ধর্ম আনলে তো বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা গণতান্ত্রিক হবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের মাধ্যমেই কেবল এ দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। ইসলাম এ দেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অর্থাৎ, ইসলামকে যদি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে না আনা হয়, তাহলে এ দেশ হয়তো অচিরেই স্বকীয় সত্তা হারাবে। ইসলামকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে না আনলে এ দেশের স্বকীয় সত্তা আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না—যা স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে বুঝেই রাষ্ট্রীয় স্বকীয় সত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যই সংবিধানে "এক আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস"-কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্থাপন করেছিলেন এবং এজন্যই তিনি রাষ্ট্রীয় ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যারা মনে করে সংস্কার না করে নির্বাচন হলেই হবে, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। কারণ রাষ্ট্র না থাকলে তারা কী রাজনীতি করবে আর, রাষ্ট্র না থাকলে রাজনীতির হালুয়া-রুটি বা পাবে কোথায়?

৫)
কিছু শিক্ষিত মানুষ মূর্খের মত কারো শেখানো বুলি তোতা পাখির মতো কেবলই বলতে থাকে, ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হলে অমুসলিম ভিন্নধর্মাবলম্বীদের কী হবে? কী আজব কথা বলেন তারা! ইসলাম তো ধর্মের পক্ষে, অথচ যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র—তা তো ধর্মের পুরোপুরি বিরুদ্ধে। অথচ সেসব ধর্মবিরোধী তত্ত্ব রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হলে তাদের কোনো বিকার নেই। কী অদ্ভুত আচরণ তাদের। কী অদ্ভুত তাদের মানসিকতা। কী দেউলিয়াপনা!
ইসলামে ধর্মীয় কারণে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর উপর আক্রমণের নজির নেই, কারণ ইসলাম সকল মানুষের জন্য (আল-কোরআন), এবং ইসলামেই আছে সকল ধর্মের মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা। অতএব, ইসলাম সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলে ‘অন্য ধর্মের কী হবে’—এমন প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী বয়ান ছাড়া কিছুই নয়।  

ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হলে যদি অমুসলিমদের অধিকারে সমস্যা হয় তাহলে সে ধরণের সমস্যা তো ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্র বা গনতন্ত্র বা জাতীয়তাবাদ বা অন্যান্য সকল মতবাদের ক্ষেত্রেই তৈরী হবে। কারন ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকারের কি হবে, সমাজতন্ত্র থাকলে অসমাজতন্ত্রীদের কি হবে? জাতীয়তাবাদ থাকলে অ-জাতীয়তাবাদীদের কি হবে? গণতন্ত্র থাকলে অ-গণতন্ত্রী অর্থাৎ বিপ্লবীদের কি হবে? ভোগবাদ থাকলে অভোগবাদীদের কি হবে? সেগুলোর ক্ষেত্রে সে প্রশ্নটি না উঠিয়ে কেবল ইসলামের ক্ষেত্রে উঠানো অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ন্যায়বিরূদ্ধ এবং দেশ ও দেশের জনগনকে প্রতারিত করার ও চরম অনৈক্যের পথে ঠেলে দেয়ার অপকৌশল। কারণ ইসলাম সেগুলোর মত নয়, ইসলামে অমুসলিম বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের মানবীয় অধিকার আল্লাহ নিজে নিশ্চিত করে দিয়েছেন, তাই ইসলাম থাকলে আলাদাভাবে মানবতাবাদের প্রয়োজন হয় না, ইসলাম নিজেই মানবতা নিশ্চিত করে। কিন্তু অন্য মতবাদগুলিতে মতবাদের বিরুদ্ধশক্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, তত্ত্বগতভাবে ভিন্ন মতের প্রতি ভালোবাসা থাক দূরে, সহানুভূতিশীল হতেও বলেনি কোথাও, ভিন্নমতকে কেবল সহ্য করতে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ এতটুকুই- বাস্তবে সেটাও পুরোপুরি অনুপস্থিত। অথচ ইসলাম মুসলিম, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে সবাইকে মানুষ হিসেবে আল্লাহর সৃষ্ট আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে ভালোবাসা ও সম্মান দিতে বলেছে।

৬)
কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলেন—রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? তারা এখানে কেবল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্ন করলেও অন্য জায়গায় আবার মানুষের ক্ষেত্রেও বলেন—মানুষের আবার জাত কী, ধর্ম কী? তারা সব ধর্মকে অস্বীকার করে মানুষের ক্ষেত্রে মানবতাবাদকে জীবনাচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
যাই হোক, ‘রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী’—এমন প্রশ্ন পুরোপুরি ভুল। ‘ধর্ম’-এর আরেক অর্থ হলো ‘চরিত্র’। রাষ্ট্রেরও নিশ্চয় একটি চরিত্র আছে, রাষ্ট্রের চলার নীতি আছে, কর্মকৌশল আছে—সেগুলোই রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। সুতরাং “রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী?” বললে, রাষ্ট্রের এই প্রয়োজনীয় চরিত্র বা কর্মকৌশলকেও অস্বীকার করা হয়। তাই এই কথাটাও এক্ষেত্রে ভুল।

আমরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ইসলাম আনার কথা বলি, তখনই কেবল এই কথাটা বেশি বলা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন বাইবেল হাতে শপথ নেন—তখন কিন্তু এসব সেকুলাররা সে প্রশ্ন তোলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব লোকের ইসলামবিদ্বেষ অথবা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই এ ধরনের প্রশ্ন আসে। এটা তাদের দ্বিচারিতা।
যাই হোক, আমরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ইসলামের কথা বলছি, তখন মূলত রাষ্ট্র যেসব আইন প্রণয়ন করবে, নীতি নির্ধারণ করবে—সেসব ক্ষেত্রে ইসলামকে উদ্দেশ্য হিসেবে নিতে বলছি। রাষ্ট্রের যারা প্রতিনিধিত্ব করবে, তারা সে উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারণ করবে। সরকার ও জনগণের বাইরে রাষ্ট্রের তো আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ইসলাম হলে সেখানে আমরা রাষ্ট্রের ‘ধর্ম’ বলছি না, বরং যারা নীতি প্রণয়ন করবে তাদের লক্ষ্য বা দিকনির্দেশনার কথা বলছি। সুতরাং “রাষ্ট্রের ধর্ম কী?”—এই প্রশ্ন করে মূলত ইসলামের মতো একটি মহান তত্ত্বকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে দেখতে চায় না যারা, তারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এই প্রশ্নটি একেবারেই অর্থহীন, কারণ অন্য তত্ত্ব যদি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হতে পারে, ইসলামের মতো সুমহান তত্ত্ব কেন হতে পারবে না?

ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হওয়াই সঠিক। তখন রাষ্ট্রধর্ম না থাকলেও চলে, কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি—রাষ্ট্রধর্মের চেয়েও বেশি কার্যকর। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে “আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস” প্রতিস্থাপনের চেয়ে “ইসলাম” প্রতিস্থাপনই সঠিক কর্মপন্থা, কারণ মূলনীতি আইন প্রণয়নের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে।
কেবল “আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস” আইনপ্রণয়নের গাইডলাইন হিসেবে যথেষ্ট নয়, কারণ এটি কোনো code of conduct নয়—code of conduct হচ্ছে ইসলাম। প্রয়াত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান “আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস” যোগ করে বিষয়টা সহজ করে দিয়েছেন।

তাই বাংলাদেশের সংবিধানে “আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস” মূলনীতি হিসেবে আগে থেকেই ছিল। সুতরাং “আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস”-এর সাথে “এবং ইসলাম” শব্দযুগল যোগ করাটা জনগণের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং সংবিধান রচয়িতাদের জন্যও কঠিন কিছু নয়। এটি কেবল তাঁদের সচেতনতার বিষয়।ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে এভাবে লেখা যায়: “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ইসলাম; তবে মুসলিম ছাড়াও দেশের নাগরিক হিসেবে অন্য সকল ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা ভোগ করবে।”

৭)
ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা অথবা ধর্মশূন্যতার প্যারাডাইমের স্পেকট্রামে ফিল্ড অ্যানালাইসিস করি একটু—প্রথম কথা হচ্ছে, মানুষবিহীন রাষ্ট্রের কোনো পৃথক সত্তা নেই, এটি প্রাকৃতিক সত্তা নয়, এটি কৃত্রিম-রাজনৈতিক সত্তা (Politico-legal entity)। রাষ্ট্র শুধু মানুষের জন্য। মানুষের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। মানুষের সামষ্টিক কল্যাণের জন্যই মানুষ রাষ্ট্রকে গড়ে তোলে বা ধ্বংস করে। সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজের পরিচালনাকারী বা প্রধান উপাদান মানুষ।
তাই একদিকে যেমন সামষ্টিক মানুষের কল্যাণের চাইতে রাষ্ট্রকে বড় করে তোলা বা মনে করা অনুচিত, তেমনি রাষ্ট্রকে কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করাও উচিত নয়।

দ্বিতীয়ত যে প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যেমন—
লোকেরা দুর্নীতি থেকে কেন বিরত থাকবে?
কেন পতিতালয় যাবে না?
কেন দেশের টাকা বিদেশে পাঠাবে না?
কেন ছেলে-মেয়ে অবৈধ মেলামেশা করবে না?
কেন কেউ রাষ্ট্র বা সমাজ রক্ষার জন্য বা বিভিন্ন বিপ্লবে (যেমন ২৪-এর বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান) নিজের মহামূল্যবান জীবন অকাতরে বিলিয়ে দেবে?
কেন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাবে না?
কেন একটা পুরুষ দশ-বারোটা রক্ষিতা রাখবে না?
কেন কেউ দেশকে ভালোবাসবে?
কেন বাবা-মা বা ফ্যামিলির যত্ন নেবে?
কেন মানবিকতার পক্ষে দাঁড়াবে?
কেন বিদেশি আগ্রাসন থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করার চিন্তা করবে?
কেন সুযোগ পেলেই নিজের ব্যক্তিশক্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবে না?
একজন লোক রাষ্ট্রে যদি শক্তিধর হয়, তাহলে সে রাষ্ট্রকে কেন নিজের ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে ব্যবহার করতে পিছপা হবে?

এগুলো তো সবকিছুই সুখের বিষয়। মানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই সুখের বিষয় আছে, এভাবে লিখলে তালিকা লম্বা হবে তাই লিখলাম না, বুঝে নিলেই চলবে।

রাষ্ট্রীয় উন্নতির জন্য কাজ করতে হলে বা রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য অত্যাবশ্যক একটি জিনিস হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের সে লক্ষ্যে অর্থাৎ সামষ্টিক স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ স্যাক্রিফাইস করা। ব্যক্তি মানুষের স্যাক্রিফাইস ছাড়া কোনোভাবেই রাষ্ট্রের ঐক্য বা রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয়।
একটি রাষ্ট্রে মানুষ সুখকে বিলীন করে স্যাক্রিফাইস করবে দুটি কারণে—

প্রথমত, কোর্ট-পুলিশ দ্বারা বা অধিকাংশ জনগণের ভয়ে সে যদি এই স্যাক্রিফাইস করতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে সে সুযোগ পেলেই লুটপাট বা ব্যক্তি স্বার্থে অপরাধ করবে। এই কৃত্রিম ও ভঙ্গুর ভীতির উপর ভরসা করে মানুষকে এসব থেকে এক দিনের জন্যও বিরত রাখা সম্ভব নয়। মানুষ কোর্ট-পুলিশকে চাইলেই ফাঁকি দিতে পারে বা এমনকি হাতের পুতুলেও পরিণত করতে পারে।
কোর্ট-পুলিশের ভীতি বা জনগণের ভয় যে কতটা অনির্ভরযোগ্য, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যেভাবে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত স্বার্থে হাতের মোয়ার মতো ভক্ষণ করেছে—সেটিই তার প্রমাণ।

অথবা দ্বিতীয়ত, সে যদি মানবতার প্রতি ভালোবাসার কারণে সামষ্টিক স্বার্থে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে তাহলেও সে কিছু অপরাধ না করার স্যাক্রিফাইস করবে।

মানবতা তার জীবনে এমন কী উপকার করেছে যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সামষ্টিক স্বার্থে নিজের সকল স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, নির্জনে সুযোগ পেয়েও অপরাধ থেকে মুক্ত থাকবে, ভোগবিলাস ত্যাগ করবে? মানবতার প্রতি ভালোবাসার খাতিরে সে মানুষের উপর নিপীড়ন করবে না, ব্যক্তি স্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে না—সেটা তো তার দয়া মাত্র।
এরকম ঠুনকো দয়ার উপর ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া যায় না, কারণ মানবতার খাতিরের বাঁধ এতই ভঙ্গুর যে এক মিনিটও তার উপর ভরসা করা যায় না। যেমন—তার ভোগবিলাস যদি এদেশের পরিবর্তে ভারত নিশ্চিত করে, সে মুহূর্তেই দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ভারতের পক্ষ অবলম্বন করতে সময় ক্ষেপণ করবে না। 

আপনারা এটাকে হয়তো কঠিন মনে করছেন। কিন্তু বিষয়টি তত কঠিন না। বাংলাদেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভিসা বা নাগরিকত্ব দিলে কয়জন মানুষ দেশ ছেড়ে যাবে না বা আমেরিকার নাগরিকত্ব নেবে না? খুব কম সংখ্যক মানুষই পাওয়া যাবে যারা আমেরিকার নাগরিকত্ব নেবেন না।
এই উদাহরণ থেকেই পরিষ্কার, রাষ্ট্রসত্তা, ৭১-এর চেতনা, জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম—রক্ষাকবচ হিসেবে কতটা ভঙ্গুর।

অতএব, রাষ্ট্রের সংবিধান ও মৌলনীতিতে স্রষ্টা ও পরকালের ধারণা (ধর্ম) লাগবে। কারণ, উপরোক্ত ব্যক্তি স্বার্থ ও সুখের যেসব কথা বললাম, স্রষ্টা ও পরকালের ধারণার কারণে মানুষ বিশ্বাস করে যে স্রষ্টা পরবর্তীতে তাকে সামষ্টিক স্বার্থে তার এ স্যাক্রিফাইসের পুরস্কার দেবেন, বা স্যাক্রিফাইস না করলে শাস্তি দেবেন—এই চিন্তা বা বোধের কারণে সে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ভোগের স্যাক্রিফাইস করবে।

বস্তুবাদ, ভোগবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা পাশ্চাত্য ধারণায় সে স্যাক্রিফাইসের ধারণা নেই। তাহলে পাশ্চাত্যে কি সুশাসন নেই? সেখানে রাষ্ট্রীয় সুশাসন আছে, কিন্তু প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মহত্যা থেকে রাষ্ট্র মানুষকে রক্ষা করতে পারছে না।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। একটা যুদ্ধেও এক বছরে এত মানুষ নিহত হয় না। তাহলে এত বড় মানবিক বিপর্যয়েও রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই? এর চাইতে বড় রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা আর কী থাকতে পারে? এরপরও রাষ্ট্র যদি এর দায় না নেয়, সে রাষ্ট্র থাকার প্রয়োজন কী?

এহেন রাষ্ট্র থাকা, না থাকা একপ্রকার সমান কথা। সেখানে কেন এমনটা হচ্ছে—সেটারও কারণ আছে। এখানে সেসব আলোচনা করা সম্ভব নয়।

অতএব, আমরা পাশ্চাত্য বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতিতে চলতে পারি—এতে আমরা হয়তো রাষ্ট্রীয় সুশাসন আনতে পারব, বা বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে পারবো, কিন্তু রাষ্ট্রের যে মূল জনগণ—সে জনগণকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো না।

স্রষ্টা ও পরকালের ধারণার মাধ্যমে ডাবল প্রোটেকশন হয়, যেহেতু:
(১) স্রষ্টা ও পরকালের ধারণা মানুষের মধ্যে কোর্ট-পুলিশের অবর্তমানে (গোপনে) ও নিজের ইচ্ছায় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার বোধ জাগ্রত করে (রোজাতে যেমন গোপনেও প্রত্যেক রোজাদার পানাহার থেকে বিরত থাকে)। এই ব্যক্তিগত বোধ জাগ্রত করার বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতায় নেই।
কারণ, মানুষ যে কারণে অপরাধের সুখ থেকে বিরত থাকার স্যাক্রিফাইস করবে, সে পরকালীন পুরস্কারের ধারণা ধর্মনিরপেক্ষতা বা বস্তুবাদে নেই।
(২) আবার স্রষ্টা ও পরকালের ধারণা কোর্ট-পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করে।

সুতরাং কোর্ট-পুলিশের মাধ্যমে এবং নিজস্ব বোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখা যায়, ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রাখা যায়, দেশ বিক্রি থেকে বিরত রাখা যায়, অমানবিকতা থেকে বিরত রাখা যায়।

তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত হতে হবে এবং এর মধ্যে অবশ্যই ন্যায়বিচার ও মানুষের জীবনচারে ন্যায়বোধের ধারণা থাকতে হবে। এরপর শুধু একটা প্রশ্নই থাকে।
সেটা হল—বুঝলাম স্রষ্টা ও পরকালের ধারণা মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখবে এবং সামষ্টিকভাবে মানুষ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে, কিন্তু সে স্রষ্টা ও পরকাল যদি বাস্তবে না থাকে?

এর উত্তরে বলছি—যারা বুঝে শুনে বিশ্বাস করে, তারা তো করেই। এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না কারণ এ লেখার বিষয় সেটি নয়।
শুধু সংশয়বাদীদের জন্য দুটি কথাই বলবো:
প্রথমত, পৃথিবীতে কোনো মানুষ, দার্শনিক বা বিজ্ঞানী—কেউই কখনও আল্লাহ/স্রষ্টা/গড/ভগবান না থাকার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়।
দ্বিতীয়ত, স্রষ্টা-পরকাল যদি বাস্তবে নাও থাকে, তবু এ ধরায় ভালো থাকবার প্রয়োজনে, সমাজে সুফল বয়ে আনার নিমিত্তে সে না-দেখা ঈশ্বর ও পরকালকে বিশ্বাস করা বা মেনে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

অতএব, এদেশে বিশুদ্ধতার বিচারে হোক বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে হোক, ইসলামই একমাত্র সমাধান। ইসলামকে সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে না আনা—এদেশ ও ১৮ কোটি জনগণের উপর একটা চরম জুলুম ও ধোঁকাবাজি।
এরকম সাংবিধানিক ধোঁকাবাজি দিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, কোনো রাষ্ট্রকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
বিশেষত যে ৯০% মুসলমানের দেশের তিনপাশেই শত্রু রাষ্ট্র ও ইসলামবিরোধী সরকার ও জনগণ রয়েছে—সে দেশের সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাকে এক সুতায় গাঁথার মতো আদর্শ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে না এনে কোনোভাবেই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা বা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়।

সে ইসলামকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে এতদিন সংবিধানে না আনার কারণেই—এ দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়নি, বাহিরের শত্রু রাষ্ট্র ও এ রাষ্ট্রকে আঘাত হানতে পেরেছে বারবার। ভবিষ্যতেও সংবিধানে ইসলামকে হয়তো আনা হবে না—এতে ইসলামের নিজের কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু এ দেশ ও দেশের মানুষ আগুনে জ্বলতে থাকবে অবিরাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসলাম আনা হবে সংবিধানে।

যে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব হল, সেই বিপ্লবীদের বলি—ইসলামকে বাদ দিলে, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে তেমন কী আর পার্থক্য থাকে? ভারতের সবকিছু মেনে নিতে সমস্যা কী থাকে?
ইসলামকে বাদ দিলে, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশ আর আওয়ামী শাসনের পার্থক্যই বা কী থাকে?
ইসলামকে বাদ দিলে, বর্তমান আওয়ামী লীগের হাতে গড়া ৭২-এর সংবিধান ও সংস্কারকদের কল্পিত সংস্কারকৃত সংবিধানের মধ্যে কী পার্থক্য থাকে?
ইসলামকে বাদ দিলে, অন্য রাজনৈতিক দল এলে যে ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে না, বা তারা গণহত্যাকারীদের সাথে একই সুরে আন্দোলন করে আবার ফ্যাসিবাদ কায়েম করবে না—তার গ্যারান্টি কী?
ইসলামকে বাদ দিলে, হাসিনার শাসন ও হাসিনাহীন শাসনের মধ্যেই বা কী পার্থক্য থাকে?

ইসলাম বাদ দিয়ে যদি ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার এ বিপ্লবকে চিন্তা করা যায়, তাহলে এ বিপ্লবকে দুদিন পরেই বুদ্ধিজীবী ও জনগণ ছেলেখেলা হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শুরু করে দিলে প্রতিরক্ষা দেওয়ার মতো যুক্তি আমাদের হাতে থাকবে না, তখন হয়তো দেশে গৃহযুদ্ধ ঠেকানোও আমাদের পক্ষে কঠিন হবে।

মনে রাখতে হবে, ইসলাম ছাড়া ব্যক্তি ও রাষ্ট্রে শান্তির চিন্তা বৃথা।

আপনার পাঠানো লেখাটির শুধুমাত্র বানান সংশোধন করে শুদ্ধরূপে নিচে উপস্থাপন করা হলো। ভাষা ও বক্তব্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে:


আবার কেউ কেউ বলবে আদর্শ নিয়ে এত মাতামতির দরকার কী, শুধু জনগণের মৌলিক চাহিদা রক্ষার চেষ্টায় নিয়োজিত হলেই তো হয়?
সেখানে কথা হচ্ছে, যারা ইসলামের কথা আনলেই বলেন আদর্শের প্রয়োজন নেই, তাহলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র—এসব আদর্শ বা মতবাদগুলো বাদ দিয়ে দেন না কেন? সংবিধান বা গঠনতন্ত্রেরও বা বিশেষ কী প্রয়োজন, শুধু জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করলেই তো হয়।

দেশে এখন একটা সংস্কারের জিগির চলছে, এরকম জিগির পূর্বেও উঠেছিল ২০০৭-২০০৯ এর দিকে। কিন্তু প্রকৃত কোনো সংস্কার আনা যায়নি, বরং দেখা গেছে—এরপর আরও শতগুণ বেশি ফ্যাসিবাদ দেশের উপর চেপে বসেছিল। সংস্কারের চিন্তাকারীরা হয়তো নিজেরাই জানেন না, কীভাবে সংস্কার করলে দেশে শান্তি আসবে।

তাই আমি সবদিক বিবেচনা করে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা/অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে—এ দেশের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি হিসেবে ইসলামকে প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানাচ্ছি।

সরকার যদি এ প্রস্তাব না মানে, তাহলে সরকারকে অবশ্যই সেকুলারিজম ও ইসলামের মধ্যে গণভোট দিতে হবে, না হলে দেশের মানুষ ইসলামকে উপেক্ষার ষড়যন্ত্রভিত্তিক, গণতন্ত্রবিরোধী মাফিয়া রাজনীতি কখনোই মেনে নেবে না।

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই যে কেবল নির্বাচন দরকার তা নয়, আগে রাষ্ট্রের নীতি ঠিক করার জন্যও জনমত যাচাইয়ের নিমিত্তে নির্বাচন প্রয়োজন। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণের জন্য আগে ইসলাম ও সেকুলারিজমের মধ্যে গণভোট আয়োজন করতে হবে, তারপর পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে হবে।

গণভোটও দিবেন না, অথচ ইসলামকে সংবিধানে উপেক্ষা করবেন—এমন গণবিরোধী, জাতিরাষ্ট্র-বিনাশী রাজনীতি আমরা যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে চলতে দিতে পারি না।

 

 

লেখক:
মোহাম্মদ আজিজুল হক 
এলএল.বি. (অনার্স), এলএল.এম. - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট 

সানজানা

×