
আমাদের জমির উপর দিয়ে রেল যায়, কিন্তু আমাদের জন্য নয়-অবহেলিত মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, শ্রীনগর, সিরাজদিখানের বাসিন্দাদের হতাশা।ঢাকা–মাওয়া–ভাঙ্গা রেলপথকে বলা হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর নতুন যোগাযোগের সোনালী সেতু। এই রেলপথ দিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন ছুটে চলে খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জের দিকে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া এই ট্রেন বদলে দিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের যাতায়াতের দৃশ্যপট।
কিন্তু এই রেললাইন যে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং, শ্রীনগর আর সিরাজদিখান উপজেলার বুক চিরে চলে গেছে—সেই মানুষেরা এর সুফল পাচ্ছেন না।
মুন্সীগঞ্জের মানুষ জমি দিয়েছে, ঘরবাড়ি ছেড়েছে, শেকড় উপড়ে ফেলে রেললাইনের জন্য জায়গা ছেড়েছে। সরকারি নথি অনুযায়ী লৌহজংয়ে মাওয়া স্টেশন, শ্রীনগর স্টেশন, আর সিরাজদিখানের নিমতলা স্টেশন তৈরিও করা হয়েছে। রেলওয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনায় লেখা হয়েছিল এটি হবে স্থানীয় যাত্রীদের জন্যও এক নতুন দিগন্ত।
ঢাকা থেকে ছুটে আসা পদ্মা এক্সপ্রেস হোক বা কোনো স্পেশাল ট্রেন এগুলো এই তিন স্টেশনে একবারও থামে না। যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো মাওয়া, শিবচর, ভাঙ্গা ছাড়া অন্য কোথাও থামে না। শ্রীনগর স্টেশনটি দাঁড়িয়ে আছে নীরবে, যাত্রীদের জন্য বন্ধ দরজার মতো। সিরাজদিখানের নিমতলা স্টেশন কার্যত অচল হয়ে পড়ে আছে।
যা হয়েছে তা এক ধরনের উন্নয়ন-বিচ্যুতি বা একতরফা পরিকল্পনা। সরকার বলেছিল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগসূত্র হবে এই রেললাইন। সত্যিই তাই হয়েছে। কিন্তু সেই ‘যোগসূত্র’ কি মুন্সীগঞ্জের মানুষদের জন্যও তৈরি? নাকি তারা কেবল পথ করে দিয়েছে অন্যদের জন্য?
এই রেলপথের নির্মাণে মুন্সীগঞ্জে হাজার হাজার মানুষ তাদের বসতভিটা, আবাদি জমি ছেড়েছেন। অনেকেই ক্ষতিপূরণ পেলেও হারানো শেকড় ফিরে পায়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল, এই রেলপথ তাদের জীবনধারায়ও নতুন গতি আনবে। কিন্তু ট্রেন থামে না তাদের জন্য। উন্নয়নের সুর মেলে অন্যের জীবনে, নিজেদের জীবনে কেবল বেদনার সুর।
লৌহজংয়ের মাওয়া স্টেশন পুরোপুরি তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তবু আন্তঃনগর কোনো ট্রেন থামে না। শ্রীনগর স্টেশন শীতল নিস্তব্ধতায় জমে আছে। নিমতলা স্টেশন হয়ে উঠেছে অব্যবহৃত একটি কাঠামো। অথচ আশপাশের মানুষ প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জ জেলার এই তিন উপজেলার মানুষের জীবন ঢাকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। শ্রীনগর, সিরাজদিখান আর লৌহজং থেকে হাজার হাজার মানুষ কাজের জন্য প্রতিদিন ঢাকায় যাতায়াত করেন। দূরপাল্লার নয়, বরং স্বল্প দূরত্বের জন্য যাত্রীবান্ধব কমিউটার ট্রেন বা শাটল সার্ভিস চালু হলে এই অঞ্চলের যাত্রীদের জীবন অনেক সহজ হতো।
রেলওয়ের পরিকল্পনা নথিতে এমন লোকাল বা কমিউটার ট্রেনের সম্ভাবনা একসময় উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকা–মাওয়া রেলপথে ট্রেনগুলো ছুটে চলে কেবল দূর গন্তব্যে, যেন এই জেলার মানুষ সেখানে নেই।
এমন অবস্থা শুধু যাতায়াতের সমস্যা নয় এটি অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও প্রতিচ্ছবি। মুন্সীগঞ্জ জেলার এই অংশের মানুষেরা তাদের জমি দিয়ে রেলের জন্য পথ করে দিয়েছে, অথচ রেল তাদের জন্য কোনো পথ রাখেনি।
স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, নীতি-নির্ধারকরা এই সমস্যার সমাধান চান। চাওয়া একটাই লৌহজংয়ের মাওয়া স্টেশনকে কার্যকর করা হোক।শ্রীনগর স্টেশনে থামুক অন্তত কিছু যাত্রীবাহী ট্রেন।সিরাজদিখানের নিমতলা স্টেশনকে অন্তত লোকাল বা শাটল ট্রেনের জন্য ব্যবহার করা হোক। ঢাকা–মাওয়া রুটে নতুন কমিউটার বা লোকাল ট্রেন চালিয়ে স্থানীয় যাত্রীদের যাতায়াতের কষ্ট লাঘব করা হোক। কারণ এই রেলপথ উন্নয়নের প্রতীক। আর উন্নয়ন কারো জন্য বেদনা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়।মুন্সীগঞ্জের মানুষের কণ্ঠে এই একটাই আর্তি:“আমাদের জমির উপর দিয়ে রেল যায় কিন্তু আমাদের জন্য নয়।”
এ নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি তারা মানববন্ধন করেছেন। ব্যানারে লেখা ছিল “আমাদের জমির উপর দিয়ে রেল যায়কিন্তু আমরা সুফল পাই না।”এক বয়স্কা নারী বলেন,সরকার বলল উন্নয়ন হবে। আমরা জমি ছেড়ে দিলাম। ঘর হারালাম। কিন্তু এখন দেখি, আমাদের জন্য কিছুই নেই।
আফরোজা