
ছবি: সংগৃহীত
লাল লাল চোখ, এলোমেলো ময়লা চুল। ছেড়া গেঞ্জি আর ধুলোবালিতে গা ঢাকা দেওয়া প্যান্ট পরে বসে আছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের এক কোণে। কখনো একা, কখনো দলবদ্ধ হয়ে। এই জোটবদ্ধতার পেছনে নেই বন্ধুত্বের গল্প—আছে নেশার হাতছানি।
যে বয়সে হাতে থাকা উচিত বই-খাতা, সেই বয়সেই তারা বস্তা কাঁধে জীবিকার খোঁজে নেমে পড়ে শহরের রাস্তায়। ফেলে দেওয়া বোতল, টিন, প্লাস্টিক—ভাঙারি কুড়িয়ে সেই বিক্রির টাকায় চলে তাদের ক্ষুধার যুদ্ধ। তবে সেই যুদ্ধে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে আরও ভয়ংকর এক অভ্যাসে—আঠার নেশা।
শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই নয়, এসব শিশুরা বলছে—আছে ভুলে থাকারও কারণ।
ওদের একজন জানায়,
"এ আঠা নাকে গেলে মাথা ঝিম ঝিম করে, ঘুম আসে। বাবা-মা হারানোর কষ্ট ভুইলা যাই।"
আবার কেউ বলছে,
"ময়লা কুড়াইতে গেলে হাত পা কেটে যায়, গন্ধে বমি আসে। তখন এই আঠা একটু শান্তি দেয়।"
রাজধানীর আব্দুল্লাপুর থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত পথশিশুদের ছিন্নভিন্ন জীবনের অসংখ্য চিত্র। ওয়াইজঘাটে দেখা গেল, চারজন শিশুর দল ড্যান্ডি নামের একধরনের আঠা নিয়ে ব্যস্ত। বয়স সাত থেকে দশ। এটাই তাদের ঘুম, এটাই তাদের স্বস্তি।
শুধু আঠা নয়—পথশিশুদের মধ্যে গাঁজা, সিরিঞ্জ, ঘুমের ওষুধ, এমনকি পলিথিনে গামবেল্ডিং কিংবা পেট্রল শুকেও নেশা করার প্রবণতা রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত, অনিয়ন্ত্রিতই থেকে যাচ্ছে ওদের জীবন।
সরকারি হিসেবে পথশিশুর সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়, আবার তাদের মধ্যে কতজন নেশায় আসক্ত, তাও স্পষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, পথশিশুদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো মাদকসেবনে জড়িত।
সারাদিন রোদে ঘুরে কাগজ কুড়িয়ে কিংবা যাত্রীদের বোঝা টেনে যে সামান্য টাকা তারা আয় করে, তার বড় একটি অংশই ব্যয় হয় নেশার পেছনে। যেন বেঁচে থাকাও আর মৃত্যুর পথ থেকে খুব আলাদা কিছু নয়।
এই শিশুরাও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল, আকাশের তারা ছুঁতে চেয়েছিল, স্কুলে যেতে চেয়েছিল ব্যাগ কাঁধে। আজ তারা ব্যাগের বদলে বস্তা কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে বাস্তবতার নির্মমতা।
সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার—সব জায়গা থেকেই তারা আজ ছিটকে পড়েছে। অথচ ওদের জন্য দরকার ছিল শুধু একটু সহানুভূতি, একটু যত্ন, আর ভবিষ্যতের হাতছানি।
নেশা নয়, দরকার ছিল নতুন স্বপ্নের।
আর সেই স্বপ্ন না এলে এভাবে একে একে হারিয়ে যাবে ওরা—কেউ খেয়ালই করবে না।
শেখ ফরিদ