
পেটের ভিতর নীরবে বাস করা এক সাধারণ ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘ মেয়াদে ডেকে আনতে পারে প্রাণঘাতী বিপদ। সম্প্রতি একটি গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়েছে, এই ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হয়ে মাত্র একটি প্রজন্মের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।
'নেচার মেডিসিন' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে, তাদের মধ্যে জীবদ্দশায় ১ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এসব ক্যান্সারের ৭৬ শতাংশই ঘটতে পারে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি (H. pylori) নামক এক ব্যাকটেরিয়ার কারণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অধীনস্থ আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) এই গবেষণাটি পরিচালনা করে। তারা বলছে, হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি'র সংক্রমণ শিশু বয়সেই হয়ে যায়, এবং এটি অনেক বছর ধরে দেহে বিরাজ করলেও উপসর্গ প্রকাশ করে না। ফলে মানুষ জানতেই পারে না, শরীরে কীভাবে বেড়ে উঠছে এক প্রাণঘাতী বিপদের বীজ।
প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু বিপজ্জনক ক্যান্সার
বিশ্বজুড়ে ক্যান্সারের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে পাকস্থলীর ক্যান্সার। প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার মানুষ মারা যান এই ক্যান্সারে। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, এটি প্রতিরোধযোগ্য ক্যান্সার। কিন্তু একবার রোগ ধরা পড়লে, চিকিৎসার সুযোগ ও সফলতা খুবই সীমিত।
এই গবেষণায় বলা হয়, পাকস্থলীর ক্যান্সার তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে দীর্ঘমেয়াদি H. pylori সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ আস্তরণে প্রদাহ তৈরি করে, আলসারের জন্ম দেয় এবং ধীরে ধীরে ক্যান্সারের আশ্রয় তৈরি করে দেয়।
বিশ্বব্যাপী বাড়বে ক্যান্সার ঝুঁকি, এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত
গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, বর্তমান সংক্রমণের ধারা অব্যাহত থাকলে, ২১০১ সালের মধ্যে ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি-সম্পর্কিত পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৮০ লাখ রোগী হবে এশিয়াতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও আইসল্যান্ডে প্রায় ৪ লাখ ৭১ হাজার রোগী পাওয়া যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বর্তমানে যেখানে সাব-সাহারান আফ্রিকায় পাকস্থলীর ক্যান্সার কম দেখা যায়, ২১০১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে ১৪ লাখ কেস পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা বর্তমানের চেয়ে ৬ গুণ বেশি। গবেষকরা মনে করছেন, এর পেছনে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসংখ্যার আকার ও গঠনের পরিবর্তন দায়ী।
চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন প্রতিরোধ
গবেষক দলটির অন্যতম সদস্য ডা. জিন ইয়ং পার্ক বলেন, “জনমিতিগত পরিবর্তনের কারণে আগামী কয়েক দশকে বহু অঞ্চলে পাকস্থলীর ক্যান্সারের বোঝা বাড়বে। এই বাস্তবতায় এখনই সমন্বিত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আঞ্চলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রস্তুত রাখতে হবে।”
গবেষণায় স্বীকার করা হয়, অনেক নিম্ন-আয়ের দেশের তথ্য অপ্রতুল হওয়ায় পুরোপুরি নিশ্চিত পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। তবুও গবেষকরা জোর দিয়ে বলেন, প্রাপ্ত তথ্য যথেষ্ট পরিমাণে স্পষ্ট এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তারা পরামর্শ দেন, H. pylori শনাক্ত ও চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করতে। গবেষণা অনুযায়ী, এমন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা গেলে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।
ডা. পার্ক বলেন, “স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”
একটি নীরব ব্যাকটেরিয়া শিশু বয়সে শরীরে প্রবেশ করে, বছরের পর বছর কোনো লক্ষণ ছাড়াই বেড়ে ওঠে, এবং শেষ পর্যন্ত পরিণতি হতে পারে এক মারাত্মক ও প্রাণঘাতী ক্যান্সারে। হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি যদি সময়মতো শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এখনই প্রয়োজন, এই নিরব ঘাতকের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
সূত্র:https://tinyurl.com/3hje9m5f
আফরোজা