
‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’ বলেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি তার আঠারো বছর বয়স কবিতায় তারুণ্যের জয়গান করেছিলেন। সেই জয়গান যেন কবিতায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবে দেখা দিয়েছিল চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজার ধস নেমেছে তরুণদের পালস বুঝতে না পেরে। আবার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার উৎখাত হয়েছে তরুণদের পালস বুঝতে না পেরে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের দুঃশাসনে পতিত সৈরাচারের গুম, খুন, দুর্নীতি, অবৈধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এক দফা ঘোষণা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ মোট ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় গরিব ও অসচ্ছল পরিবার থেকে সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোটা সুবিধা নিয়ে একই পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তি সরকারি চাকরি পেলেও অনেকে কঠোর পরিশ্রম করেও সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। ২০১৮ সালে কঠোর আন্দোলনের ফলে সরকার চাপের মুখে কোটা পদ্ধতি সংস্কার না করে সুকৌশলে সম্পূর্ণ কোটা পদ্ধতি বাতিল করেন। তখন সৃষ্টি হয় আইনি জটিলতা। তখন হাইকোর্টে আপিল করেন কোটাধারীরা। সেই আপিলের রায়ে আবার কোটা পুনর্বহাল করলে আবারও রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। চব্বিশের শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে মানুষকে আহত ও নিহত করে। ঠিক তখন কোটাবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় একদফা অর্থাৎ সরকার পতনের আন্দোলনে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে সরকার পতনের জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করলেও সাধারণ মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কখনো রাজপথে নেমে আসেনি। কিন্তু কোটা আন্দোলনে সরকার অধিক মাত্রায় দমন-পীড়ন শুরু করলে এবং একের পর এক আন্দোলকারীর ওপর স্বৈরাচার সরকার ও তার সহযোগীরা হামলা-মামলা ও নানাভাবে নির্যাতন শুরু করলে, বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, রিমেম্বার আওয়ার হিরোয়েসসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ভীত কেঁপে ওঠে। তখন শেষ মুহূর্তে এসে কোটার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় কিন্তু এই দাবি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শত শত মানুষ শহীদ হন। এই হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথে নামলে আবারও দমন-পীড়ন শুরু করে তৎকালীন সরকার। ভবিষ্যতেও যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে তাদের উচিত হবে তরুণদের পালস বোঝা, তৃণমূলে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা এবং গুম, খুন, চাঁদাবাজির ইতি টেনে মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করা। যদি এটি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আবারও হয়তো কোনো একদিন তরুণদের নেতৃত্বেই অনাগত বিপ্লব সংঘটিত হবে।
আন্দোলন চরম পর্যায়ে গেলে, বিভিন্ন দফা দাবি ঘোষণা করে। সেগুলো মেনে না নিয়ে দমন-পীড়ন চালু করলে একপর্যায়ে নয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। কিন্তু সেটিও সরকার মেনে না নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে দমন-পীড়ন শুরু করেন। তখন শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে একদফা ঘোষণা করেন। তখন তারা বলেন লংমার্চ টু গণভবন। প্রথমে ৬ আগস্ট লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও পরে তা একদিন এগিয়ে অর্থাৎ ৫ আগস্ট লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।’ এই ব্যানারে দল-মত নির্বিশেষে রাজপথে নেমে আসেন দেশের আপামর জনতা এবং বিপ্লব সফল করে আনন্দ মিছিল করে বাড়ি ফেরেন দেশের জনতা। এখানে একটি জিনিস লক্ষণীয় যে, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বিএনপি, জামায়াত, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদসহ দেশের প্রথম সারির দলের নেতারা বারবার ১ দফার ঘোষণা করলেও তাদের আন্দোলনে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ বারবার রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে প্রতারিত হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকে সারা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতারা বিগত বছরগুলোতে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয় তৃণমূলের শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। এছাড়াও মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন যে কেন গুম, খুন, লুটপাটের ইতিহাস শেষ করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং শোষণ, বৈষম্যের বিদায় জানিয়ে একটি সুন্দর, নির্মল দেশ গড়তে হবে। সেই সঙ্গে নাগরিক অধিকার ও দায়িত্বসমূহ বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
তাই বলা যায় যে, জনগণ থেকে দূরে থাকায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। ফলে তাদের দেওয়া কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে না। রাজনৈতিক দলগুলো গত পনেরো বছর রাজপথে নিষ্ফলা আন্দোলন করে স্বৈরাচার পতন করতে না পারলেও ছাত্র-জনতা সেটি মাত্র এক মাসে করে দেখিয়েছেন। কারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশের আপামর জনতার অগাধ বিশ্বাস ছিল। আর এই আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার ছিল দেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা। দেখা যায় যে শহীদ আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। এ পর্যন্ত যখন অন্যায় অবিচার দেখা দিয়েছে, তখন শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছিল। আর একমাত্র শিক্ষার্থীরাই খালি হাতে ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ও পরে ছাত্র-জনতা নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা।
জুলাই বিপ্লব যখন কোটা আন্দোলন থেকে একদফা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল তখন প্রায় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলে আসা ফ্যাসিস্ট রেজিমের নানা অনিয়ম, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, চিন্তা-বিবেক ও বাকস্বাধীনতা হরণ, গুম, খুন, ক্রসফায়ার ইত্যাদির বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল জুলাই বিপ্লবে। কারণ এ প্রজন্ম শুধু একজন শাসকেরই শাসন ব্যবস্থা দেখেছিল। জেনারেশন জেড বাল্যকাল থেকে এসব অন্যায়-অবিচার, জুডিশিয়াল কিলিং ইত্যাদি দেখে বড় হয়েছে যা তরুণদের বিপ্লবী হতে বাধ্য করেছে। সেই সঙ্গে ভারতীয় আগ্রাসন তরুণদের মনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত হত্যা, ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হওয়া অন্যায্য চুক্তি দেশের শিক্ষিত তরুণদের মনে বিপ্লবের বীজ বুনন করেছে।
দেশের গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারাকে সুসংগঠিত করতে তরুণদের নেতৃত্বে এই বিপ্লবের ভূমিকা অপরিসীম। ফ্যাসিস্ট সরকার যেভাবে দেশের বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছিল এবং ভিন্নমতকে দমনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নসহ নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল তাতে বিরোধী দল ও ভিন্নমতের মানুষের জন্য দেশে বসবাস করে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা দুঃস্বপ্ন ছিল। কোনোভাবেই যদি ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতা থেকে হটানো না যেত তাহলে দেশ সম্পূর্ণরূপে একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত হতো। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের ফলে সেটি আর সম্ভব হয়নি। জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে রাস্তায় নেমে আসা মানুষেরা যেমন ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন করেছে ঠিক তেমনি দেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখেছে। এই আন্দোলনে মূলত তরুণরা অর্থাৎ জেন-জি ছিল এক অপ্রতিরোধ্য সাহস ও শক্তির নাম। কারণ এখানে নেতৃত্ব থেকে শুরু করে রাজপথ দখলে রেখেছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ-তরুণী।
যে দেশগুলোতে অভ্যুত্থান হয়েছিল সে দেশগুলোতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নানা অরাজকতা দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশে ও তার ব্যতিক্রম নয়। এই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও অরাজকতা দেখা দিলে তরুণরা সেগুলো মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। এমনকি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আকস্মিক বন্যা দেখা দিলে তরুণদের উদ্যোগে গণত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়। সেখানে তরুণদের আহ্বানে সারা দিয়ে দেশের সর্বস্তরের জনগণ গণত্রাণের বুথগুলোতে ত্রাণ পাঠানো শুরু করেছে। এটি নিঃসন্দেহে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণদের আরেকটি মাইলফলক অর্জন করেছে। যা দেশের ইতিহাসে অনন্য।
দেশের জন্য শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসীম, মুগ্ধ, মানিক, রুদ্র, তাড়ুয়া, শিশু রিয়া গোপ, শিশু আহাদসহ নাম জানা-অজানা হাজারো তরুণ-তরুণী ও শিশু, বৃদ্ধ জুলাই বিপ্লবে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যা দেশের ইতিহাস রচনায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ছিল দেশের তরুণ-তরুণীরা। যেটি ভবিষ্যতে কখনো ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হলে সেটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস ও শক্তি জোগাবে। চব্বিশের বিপ্লবে তরুণদের অর্জন অনন্য এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, এশিয়া মহাদেশেও নেই। দক্ষিণ এশিয়া কিংবা এশিয়া বা এশিয়ার বাইরে যদি কোনো দেশে কখনো ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসেন, তাহলে তারা অবশ্যই বাংলাদেশের তরুণদের এই অনন্য অর্জনকে সাহস ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
[email protected]
প্যানেল