
আজ ১১ জুলাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘একটি ন্যায্য এবং আশাবাদী পৃথিবীতে তাদের পছন্দের পরিবার তৈরি করতে তরুণদের ক্ষমতায়ন’। মূলত এ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে, যেখানে বলা হয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির তাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। সমাজ ব্যবস্থায় আমরা কিন্তু আমাদের অধিকার সম্পর্কে আমরা যেমন সচেতন না অন্যদিকে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি এটাও বাদ দেওয়া যাবে না। সবার অধিকারের সমতার বিষয়টি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এ বিষয়ে সঠিক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারছি না। বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এ দিবসটি অনেক তাৎপর্য বহন করে থাকলেও সমানভাবে সব দেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে জনসংখ্যা কিন্তু সে হারে বাড়ছে না মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গভর্নিং কাউন্সিলে জনসংখ্যা ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়া জরুরি মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে প্রতি বছরই নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু যতই দিবস পালন করছি না কেন তার ফল মোটেও আমাদের সঠিকভাবে সামনে নিয়ে যাচ্ছে না।
সঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার কীভাবে করা যায় সেই লক্ষ্যে প্রতি বছরই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয় এ জনসংখ্যা দিবস। এ দিবসের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করাই মূল লক্ষ্য। যেসব দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে সেসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপটা একটু বেশি। অন্যদিকে কিছু কিছু দেশে জনসংখ্যা কমছে তাই তাদেরও ভিন্ন নীতি অনুসরণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু কিছু দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে তা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। জনসংখ্যা দিবসের আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার সার্বিক অবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কি হারে বাড়ছে জনসংখ্যা? আমাদের জানা দরকার অধিক জনসংখ্যা আমাদের ওপর কি চাপ সৃষ্টি করছে? অধিক জনসংখ্যার ফলে স্বাস্থ্যগত প্রভাব কি ধরনের হচ্ছে তাও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণ, ওজোন স্তর হ্রাস, বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি বিকিরণ থেকে আর রক্ষা করে না যা ত্বকের ক্যান্সার এবং অকাল ত্বকের বার্ধক্যের মতো চর্মরোগ সৃষ্টি করে, ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের উদ্ভব ও বিস্তার সহজ, বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি, বর্জ্য ক্যান্সার, স্নায়বিক ব্যাধি, জন্মগত বিকৃতিসহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে চলে আসে। শুধু যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তা কিন্তু নয়। আমাদের মতো দেশে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দিচ্ছে সম্পদের জোগান। যার ফলে পানি ঘাটতি, ভূমির ব্যবহার, জীবাশ্ম জ¦ালানি, বায়ু ও জনদূষণ, বর্জ্য উৎপাদন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, টেকসই কৃষি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো সমস্যা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য মতে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ যার মধ্যে অর্ধেক নারী এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ। আর বিশে^র জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ বিলিয়নে। গত ৭ জুলাই ‘বিশ^ জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’-সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি, যা বয়ষ্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এবং ১০-২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৫০ মিলিয়ন যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। তবে এবারের প্রতিপাদ্যের মাঝে তরুণদের প্রতি বেশি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এটা একটি ভালো দিক।
বাংলাদেশের মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১, যা মধ্যম স্তরে রয়েছে। তবে কিছু অঞ্চলে কিশোর বয়সে নারীদের গর্ভধারণের হার বেশি, যার পেছনে রয়েছে বাল্যবিয়ে, জন্মনিরোধ ব্যবস্থার সীমিত ব্যবহার এবং যৌন শিক্ষার অভাব। হ্রাস বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটা লক্ষণীয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত যেসব দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাবে তাদের মধ্যে বুলগেরিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, মলডোভা, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপগুলো অন্যতম। আর এর মধ্যে এশিয়ার দেশ জাপানের অবস্থান দশম। এসব দেশে জনসংখ্যা কমলেও শুধু অভিবাসন নীতি বা বিদেশীদের গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন কমছে জনসংখ্যা? শুধুই কি প্রাকৃতিক কারণ? গবেষণায় বলছে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে নারীর অগ্রযাত্রা, নারীর ক্যারিয়ার, শিশু লালন পালন ও শিক্ষার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগ, ভোগবাদিতা, জীবনযাত্রা ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ায় উন্নত দেশের অনেক নারী সন্তান ধারণ এমনকি বিয়েতে পর্যন্ত আগ্রহ হারাচ্ছে। এসব কারণে বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। একদিকে যেমন বাড়ছে জনসংখ্যা অন্যদিকে আবার হ্রাসও পাচ্ছে জনসংখ্যা উভয় সংকটে বিশ্ব। জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধি যেমন আমরা চাই না তেমনি চাই না জন্যসংখ্যা একেবারেই কমে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে একেক দেশের চাওয়াটা একেক রকম। প্রতি বছরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও এর সমাধানের আলোকে প্রতিপাদ্য তৈরি করে জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে থাকে তবে এ গুরুত্বপূর্ণ দিবসটির প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি করে সামনে আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সম্ভব হয়নি তাই এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে জনসাধারণের নিকট পৌঁছতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দেশে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হতে থাকবে। দেশের উন্নয়নের জন্য যত পরিকল্পনাই করি না কেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর যেসব জন্যসংখ্যা রয়েছে তাদের কর্মমুখী করে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে পরিকল্পিত জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত এটা মাথায় রেখে আমাদের মতো জনবহুল দেশে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সাধারণ বাজেটের ২ শতাংশ বরাদ্দ যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এ বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্য খাতকে আরও সুস্থ রাখতে হবে এবং জনসংখ্যাকে কর্মক্ষম করে তোলার জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে আরও বাস্তবমুখী।
লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকমী
প্যানেল/মো.