
ছবি: জনকণ্ঠ
বিপ্লব বলি আর অভ্যুত্থান বলি—এর পরবর্তী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ততই যেন বেগবান হচ্ছে। যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এই মুহূর্তে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তার ভেতরে অন্যতম হলো নির্বাচন পদ্ধতি। অর্থাৎ ‘কোন’ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করব।
সমগ্র বিশ্বে কয়েকটি নির্বাচন পদ্ধতি ও উপপদ্ধতির কার্যকারিতা বা ধারণা রয়েছে। এগুলো হলো:
১। ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট
২। সিঙ্গল ট্রান্সফারেবল ভোট
৩। অ্যাডিশনাল মেম্বার সিস্টেম
৪। অল্টারনেটিভ ভোট প্লাস
৫। টু-রাউন্ডেড সিস্টেম
৬। অল্টারনেটিভ ভোট
৭। সাপ্লিমেন্টারি ভোট
৮। বোর্দা কাউন্ট
৯। পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন
তবে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দুটি পদ্ধতি তুমুলভাবে আলোচিত হচ্ছে, সেগুলো হলো উপরের তালিকার ১ ও ৯ নম্বরটি। আলোচনার উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য এ দুটো পদ্ধতি নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে।
ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট:
পৃথিবীতে ভোটের ধারণার পর থেকেই সবচেয়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি এটি। ইংল্যান্ডে উৎপত্তি হওয়া এই পদ্ধতিটিকে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিও বলা হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত ও আমাদের বাংলাদেশসহ প্রায় ৫০টি দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। এই পদ্ধতির সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দিতে পারে এবং কোনো নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থীটি নির্বাচিত হয়। আর এই পদ্ধতিটির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো একজন ভোটারকে কখনো কখনো হয় দলের বিরুদ্ধে, নয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয়। কারণ, যেহেতু একটি দল থেকে একটি প্রার্থী ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, কোনো ভোটার একটি বিশেষ দলকে পছন্দ করলেও তার নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীকে তার পছন্দ নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে হয় সে দলকে প্রাধান্য দিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে, নয় দলের মনোনীত নয় এমন প্রার্থীকে ভোট দেবে। কারণ, এর বিকল্প নেই।
পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন:
এই পদ্ধতিটিকে আমরা সংক্ষেপে ‘পিআর’ পদ্ধতি বলছি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ইংল্যান্ডে উৎপত্তি হওয়া এই পদ্ধতিটিও বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কাসহ প্রায় ৭৩টি দেশে এ পদ্ধতি চালু রয়েছে। এই নির্বাচন পদ্ধতিটির কয়েকটি উপভাগ রয়েছে। তবে এই পদ্ধতির মূল কথাটি হচ্ছে, ভোটাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থীকে নয় বরং কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয়। দেশের সবচেয়ে বেশি ভোটপ্রাপ্ত (৫০ ভাগ বা তার বেশি) রাজনৈতিক দলটি সরকার গঠন করে এবং প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে তাদের প্রতিনিধি থাকে। এই পদ্ধতিটির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ভোটাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে না বা পারলেও তাদের সেই প্রার্থী কখনো কখনো সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় না। আর এই পদ্ধতির সুবিধাটি হল কোনো রাজনৈতিক দলের সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সামান্য কিছু ভোট থাকলেও ওই ভোটের বিবেচনায় তারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়।
বর্তমানে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে সকল মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারে প্রশ্নে সকল দল 'পিআর' পদ্ধতি চাইলেও বিএনপি এর পক্ষে নয়। কেন?
একজন শাসকের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের প্রভূত মঙ্গল সাধন করা। আর এই মঙ্গল সাধন করার জন্য তাকে ক্ষমতায় আসীন থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছায়ই শাসক নির্বাচিত হন। এই প্রক্রিয়ায় একজন শাসকের লক্ষ্য থাকে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকা। একজন শাসকের এই লক্ষ্যই থাকা উচিত এবং বিএনপিও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন সময়ে এই দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ। দেশ শাসনের অভিজ্ঞতার কারণে এবং নির্বাচিতভাবে (আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম) ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া জানা থাকার কারণে বিএনপি তার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন।
সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (SANEM)-এর পরিচালিত একটি জরিপ থেকে জানা যায় তরুণ জনগণের আগামী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের আকাঙ্ক্ষা এবং পছন্দ। জরিপটি বলছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামিকে ভোট দিতে চান যথাক্রমে ৩৮.৭৬% ও ২১.৪৫% তরুণ। তরুণদের দল এনসিপিকে ভোট দিতে চান মাত্র ১৫.৪৮% তরুণ! ১৫% তরুণ আওয়ামী লীগকে, ৪.৫৯% অন্যান্য ইসলামী দলকে, ৩.৩৭% জাতীয় পার্টিকে এবং ০.৫৭% অন্যান্য দলকে ভোট দিতে চান। একসময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কাছাকাছি রকম জনপ্রিয় থাকলেও 'ফ্যাসিজম' এর কারণে বর্তমানে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে আর ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থানের কারণে বিএনপি পৌঁছে গেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এটি বুঝতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না, একটু সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করলেই হয়। সুতরাং বিএনপি যেখানে অনেকটা নিশ্চিত বিজয় দেখতে পাচ্ছে, সেখানে নতুন কোনো ভোট-পদ্ধতি প্রয়োগের ঝুঁকি তারা নিতে চাইবে না—এটাই স্বাভাবিক। আর তা যদি কোনো বিশেষ দলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার 'ঝুঁকি' বা 'আশঙ্কা' তৈরি করে তাহলে তো কথাই নেই!
পাশাপাশি, বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। প্রার্থী না দেখে, না চিনে শুধু প্রতীকের উপরে ভোট দিয়ে তারা যে সন্তুষ্ট হতে পারবে না—এটা বৃহৎ দল বিএনপি বুঝতে পেরেছে।
তবে 'পিআর' পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থানের আরেকটি যৌক্তিক কারণ আছে বোধ হয়। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে জনগণের স্বার্থবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে। তারপরেও তাদের অনেককে দুর্নীতি বা অন্যান্য অপকর্ম থেকে বিমুখ করা যায় না। আর যখন তারা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না, তখন জবাবদিহির ব্যাপারটা কেমন হবে—এটা সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বোধ হয় জনসম্পৃক্ত দল বিএনপিও বুঝতে পেরেছে! সুতরাং 'পিআর' পদ্ধতি নিয়ে তাদের অবস্থান কেমন হবে বা কেমন হওয়া উচিত—এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত স্পষ্ট ভাবেই মীমাংসিত!
লেখক:
এস এম নাহিদ হাসান
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
ফরিদপুর, পাবনা
মুমু ২