
‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়
বন্ধ করার এখনই সময়’
এই প্রতিপাদ্য নিয়েই পালিত হলো ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবস। চারদিকে অত্যন্ত জোরেশোরেই স্লোগান তুলছি পরিবেশ দূষণ রোধে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের সকল আয়োজন আমরাই করে চলেছি। পরিবেশ দূষণের অন্যতম দূষণ হলো বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ আমাদের প্রভূত ক্ষতি করছে। বায়ুদূষণের যতগুলো দূষণ উপাদান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পার্টিকুলেট মেটার ২.৫ (চগ২.৫)। এছাড়াও রয়েছে পার্টিকুলেট মেটার ১০ (চগ১০), ওজোন (০৩), সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড প্রভৃতি ক্ষতিকারক গ্যাস। ওজোন লেয়ার আমাদেরকে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করলেও ওজোন গ্যাস বায়ুদূষণ করে মানুষের বিবিধ রোগ তৈরি করে। বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয় ইয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই দিয়ে। ঢাকা শহরে ৬ জুলাই ২০২৫ একিউআই এর মান ৮৬। এতেই বুঝা যাচ্ছে ঢাকার বাতাস কতটা দূষিত, যার প্রধানতম দূষণকারী বস্তু পিএম ২.৫। ঢাকা শহরে এই পার্টিকুলেট মেটার ২.৫-এর মান ২৮ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার। যেখানে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সূচক মান ৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন সিটার। পিএম২.৫ হলো এমন পার্টিকল যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোন। যেখানে আমাদের চুলের ব্যাস ৫০-৭০ মাইক্রোন। সে সেই হিসাব অনুযায়ী পিএম ২.৫ চুলের তুলনায় কত গুণ ক্ষুদ্র হতে পারে। এই ক্ষুদ্র পার্টিকল অতি সহজেই মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে এমনকি রক্তের সঙ্গেও মিশে যেতে পারে। এই পার্টিকলের তুলনায় রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফানগাসসহ অন্যান্য জীবাণু) আরও অনেক ক্ষুদ্র। বাতাস এর মধ্যে সাসপেনডেড প্যাথোজেনগুলোর ব্যাস ০.৫ মাইক্রোন হতে ১ মাইক্রোন। উদাহরণ হিসেবে বলা স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া, ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাক-টেরিয়া, একটিনো ব্যাকটেরিয়া, প্রোটিও ব্যাকটেরিয়া, এ্যাসকোমাইকোটা ফানগাস, সহ-অসংখ্য ভাইরাস, আরকিয়া এবং প্রোটিস্টা পিএম ২.৫ দ্বারা পরিবাহিত হয়।
এখন পরিষ্কার করে বুঝতে পারছেন পিএম২.৫ একটি অত্যন্ত কার্যকর বাহক। বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ফানগাস, অ্যাকটিনোমাইসেটস্, প্রটোকটিষ্ট প্রভৃতি অণুজীব কে বহন করে মানুষের শরীরের রক্তে মিশে দিচ্ছে এই পিএম২.৫। আমার মনে পড়ে আজ হতে ৩০ বছর আগের কথা। যখন আমি প্রথম ঢাকায় আসি। সবুজে ঘেরা বগুড়া জেলার নির্মল বায়ুতে বেড়ে উঠা এক যুবক যখন ঢাকা শহরে পৌঁছি, তখন বুঝতে পারি নাই ময়লা পরিবহনের ট্রাক এতো ভয়ংকর উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ায়ে চলতে পারে। সেদিন আসাদগেট হতে ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে যে অসহনীয় কষ্ট হয়েছিল তা এখনো আমাকে পীড়া দেয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা অবশ্য একেবারেই খেল বলে মনে হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে কদিন আমি দুপুরে খেতে পারিনি। অথচ আজ প্রতিদিন সেই পরিস্থিতির চেয়ে কত গুণ উৎকট গন্ধযুক্ত রাস্তায় চলাচল করছি হরহামেশাই। মনে হচ্ছে সকল সেন্স অরগানগুলো ভোতা হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার পরও সকাল বেলা যখন অফিসে যাই তখন রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় যে উৎকট অসহ্য দুগন্ধ ছড়িয়ে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে ময়লা পরিবহনকারী ট্রাকগুলো হুস খুস শব্দে চলতে থাকে তখন মনে হয়, বিশ্বের সরচেয়ে দুর্গন্ধময় স্থান নিউজিল্যান্ডের রোটোরোয়াতে এসে পড়েছি। আর সকালের মজা করে খাওয়া নাস্তাকে মনে হতে থাকে ডুরিয়ান ফল (যা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্গন্ধযুক্ত ফল) তক্ষণি পেট হতে বেরিয়ে আসতে চায়। বিকাল বেলা যখন পড়ন্ত বেলায় নিরস মুখে বাসায়, ফিরি তখনও রাস্তায় মনে হয় ডুরিয়ান ফল (বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফল) এবং থিওঅ্যাসিটোন (তীব্র ও অপ্রীতিকর গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ) মিশ্রিত করে কে যেন রাস্তায় ঢেলে দিয়েছে। এত সুন্দর কারুকাজটি আসলে কে করতে পারে। এত বড় শুভাকাক্সক্ষী কে? একটু পরখ করলেই দেখতে পাবেন শুভাকাক্সক্ষী আর কেউ না সেই ক্ষমতাধর ময়লা পরিবহনকারী ট্রাকটি। যে অতি সুচারুভাবে তার বাহিত পবিত্র ময়লার নির্যাস অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে রাস্তায় ঢেলে দিয়ে দুর্গন্ধ বিতরণ করতে করতে তার গন্তব্যে ধেয়ে চলছে। নামকা ওস্তে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে এই রোগ জীবাণু সৃষ্টিকারী জীবাণু যুক্ত ময়লা-আবর্জনা এমন করে পরিবহন করা কি চলতেই থাকবে। তাহলে এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ তা কি কখনই আমাদের উপলব্ধিতে আসবে না। এ কী শুধু গন্ধ ছড়িয়েই নগরবাসীকে তীব্র কষ্ট প্রদান করছে? না বিষয়টি এখানেই শেষ না। উচ্চ পিএম২.৫ যুক্ত বাতাসে এই ময়লা আবর্জনা হতে উৎপন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অতি সহজেই আমাদের ফুসফুসসহ রক্ত সঞ্চালনে মিশে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে চলছে। যে জীবাণুগুলো ছিল শহরের নির্দিষ্ট জায়গায়- সেই জীবাণুগুলোকে অপরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ ও পরিবহনের ফলে মানুষের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে। নগরীতে তৈরি করছে একটি অসহনীয় পরিবেশ। রোগ-সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন ও বাহকের সংখ্যাও পরিবেশে বৃদ্ধি করছে। ফলে অনেক সংক্রামক রোগের ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং হচ্ছে অতি সহজেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অতি নাজুক পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় কি? উপায় অবশ্যই আছে। তবে সবার আগে দেশপ্রেম ও মানবতা-প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় উপায়গুলো-নিম্নে প্রদত্ত হলো-
প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিহীন বর্জ্যকে আলাদা করতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য যেমনÑ রাসায়নিক দ্রব্য, ব্যাটারি, মেডিক্যাল বর্জ্য ইত্যাদি।
ঝুঁকিহীন বর্জ্য যেমন প্লাস্টিক, দৈনন্দিন ব্যবহত কাজে উৎপাদিত বর্জ্য, বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য ইত্যাদি।
আলাদা করার পর বর্জ্য পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যরে প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রতিটি কন্টেনার সিল করে নিতে হবে। অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন কন্টেনার ফুটো হয়ে বর্জ্য বেরিয়ে আসতে না পারে। রাস্তার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কন্টেনারগুলোতে সাজাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি কন্টেনারে লেবেল লাগাতে হবে। এসব কাজ করতে হবে নিজে যথাযথভাবে পিপিই ব্যবহার করে। এরপর সঠিক পরিবহন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার গাইড লাইন অনুসরণ করে, পরিবহনের রুট, পরিবহনের লোড ও ভেহিকল নির্দিষ্ট করে পরিবহন শুরু করা আবশ্যক। পরিবহনে কখনো যদি অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটে তা অবশ্যই মানব জাতি, অন্যান্য জীবজন্তু ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়িটি বন্ধ করে তা যথাযথ নিয়ম মেনে সমাধান করেই আবার পরিবহন শুরু করতে হবে। যেমন: যদি কোন বর্জ্য লিক হয়ে পরিবেশে পড়ে যায় বা রাস্তা দূষণ করে, তবে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা শেষেই কেবলমাত্র আবার পরিবহন শুরু করতে হবে। সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসরণ করে তা, পরিবহন ও ব্যবস্থাপন সম্পূর্ণ করতে হবে। একইভাবে ঝুঁকিহীন বর্জ্যও নীতিমালা অনুসরণ করেই ব্যবস্থাপনার আওতায় নিতে হবে। বায়োডিগ্রেডেবল বা রি-সাইকেল করা যায় এমন বর্জ্য পদার্থকে অবশ্যই বর্জ্য হতে সম্পদে পরিণত করার ব্যবস্থা করতে। আমাদের দেশের কৃষি জমিতে উপর্যুপরি রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থায় রি-সাইকেল পদ্ধতিতে বায়ো ফার্টিলাইজার তৈরি করে দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা যায়। এমনিভাবে নিজের বাসযোগ্য স্থানকে নান্দনিক ও বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমার আপনার সবার। তাই আসুন সবাই মিলে এই ধরিত্রীকে রোগমুক্ত সবুজ ঘেরা একটি শান্তির নীর হিসেবে গড়ে তুলি।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম
প্যানেল/মো.