
নীলের গাঢ় রঙে রাঙানো অতীত, রাজকীয় ফাইলের নীরব নির্দেশ আর এক বিস্তীর্ণ ধূসর সমতলের বুকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠা এক জীবন্ত নগরের নাম নীলফামারী। এ শহর যেন শুধু একটি ভূগোল নয়, একটি আবেগ, একটি ইতিহাস, একটি অতৃপ্ত অনুরণন, যার প্রতিটি ইট, প্রতিটি পথ, প্রতিটি জনপদ আজও ধারণ করে রেখেছে ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার সুনিপুণ ছাপ, কৌতূহলময় উত্থান আর জনমানসের সৃষ্টিশীল অভিযাত্রার চিহ্ন। উত্তর বাংলার এক প্রান্তে, ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া এক নির্জন জনপদ। চারপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত, ছোট ছোট গাঁওঘর আর দুর্বল আলোকিত কিছু পথ- এ যেন নিস্তরঙ্গ সময়ের এক সাদাকালো পর্দা। কিন্তু ঠিক এই নীরবতার মাঝখানেই ১৮৮২ সালে ইতিহাস লেখে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। রংপুর জেলার প্রশাসনিক রূপরেখায় হঠাৎই এক নতুন নাম উঠে আসে- নীলফামারী’। ব্রিটিশ আমলার আমলাতন্ত্রীয় ফাইলের পাতায় স্থান পায় এই নিভৃত অঞ্চলটি। ব্যুরোক্রেটিক সিদ্ধান্তের অদৃশ্য কলম যেন হঠাৎই এঁকে দেয় এক শহরের অবয়ব। আর সেই আঁচড়ে গড়ে ওঠে একটি নতুন প্রশাসনিক মহাকেন্দ্র।
বাগডোগরার প্রশাসনিক তৎপরতা সরে আসে এই নীলের ভূমিতে- যেখানে নীল চাষের অতীত, জমিদারদের কুঠিবাড়ি আর ব্রিটিশ নীলকরদের দম্ভজড়িত ইতিহাস মিলেমিশে এক জটিল ও রহস্যময় পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। শহরটি যেন কেবল এক প্রশাসনিক প্রয়োজনের বাস্তবায়ন ছিল না, ছিল এক কৌশলগত আয়োজন, যার প্রতিটি সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ ও পরিকল্পনার ধারায়। এ জায়গাটি যদি না নির্বাচিত হতো মহকুমা সদর হিসেবে, তবে হয়তো এর অস্তিত্বই হারিয়ে যেত শত-সহস্র বাঙালি গ্রাম্য জনপদের ভিড়ে। নীলফামারী নামটির উচ্চারণেই যেন ভেসে আসে কৃষকের ঘামে ভেজা নীল রঙের জমি, তিস্তা নদীর ঘোলা জল আর ফাইলের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা এক অচেনা সম্ভাবনার দীর্ঘশ্বাস। এ নাম শুধু শব্দ নয়- এ এক প্রতীক; ঔপনিবেশিক কাঠামো, নীলের ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের এক তীব্র প্রত্যাশার প্রতীক।
এই শহর জন্ম নিয়েছিল কাগজে-কলমে, কিন্তু বেঁচে উঠেছিল মানুষের ঘামে, শ্রমে ও স্বপ্নে। একদিনের প্রশাসনিক ঘোষণা ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক জীবন্ত শহরে, যার প্রতিটি অলিগলি আজও বহন করে সেই নীরব ইতিহাসের পদধ্বনি। এ শহর আমাদের শুধু ইতিহাস শেখায় না, শেখায় কীভাবে নথির নিঃশব্দ ভাষাও একদিন মানুষের জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে ওঠে। নামটির উৎস আজও বিতর্কিত। প্রাচীন কথন বলছে, নীলফামারি নামটি এসেছে ‘নীল’ তথা ইন্ডিগো চাষ এবং ‘ফান্দরি’ অর্থাৎ নিচু জলাভূমির মিশ্রণ থেকে। ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত নীলকুঠি ও তার পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ যেন সেই ইতিহাসের নীরব দলিল। এ কুঠি ছিল একদিকে ইন্ডিগো উৎপাদনের কেন্দ্র, অন্যদিকে কৃষকের কান্না আর প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। আজকের শহরের রাস্তাঘাট আর দোকানপাটের নিচে চাপা পড়ে আছে সেই শোষণের দিনলিপি।
১৯১১ সালের রংপুর গেজেটিয়ারে উঠে আসে শহরের অবয়ব। জনসংখ্যা তখন প্রায় ২ হাজার ৪০০-এর মতো, যদিও অঘোষিত লোকসংখ্যা কিছুটা বেশি ছিল বলেই অনুমান। শহরটি রেলস্টেশন থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত, পূর্ববঙ্গ স্টেট রেলওয়ের সংযোগ এই শহরের সঙ্গে তার বাইরের জগতের সেতুবন্ধ তৈরি করে। দৈর্ঘ্যে ১৪ মাইল আর প্রস্থে আধা মাইলের নীলফামারী ছিল বিস্তৃত এক জনপদ, যার বেশির ভাগই ছিল খোলা মাঠ, বালুময় মাটি ও নিচু সমতল। প্রাকৃতিকভাবে শহরটি ছিল অনন্য। প্রচুর খোলা জায়গা, বালুর ওপর গড়ে ওঠা বসতি, আর গভীর কূপ বা কুয়ার মাধ্যমে জল সরবরাহ। তবে বর্ষার শেষে পানির স্তর বেড়ে গিয়ে কুয়া উপচে পড়ত, শহরে ছড়িয়ে পড়ত নোংরা জল। তখনকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল সীমিত ও নাজুক-বর্ষা শেষে মহামারির মতো রোগ দেখা দিত আর শহরের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ত। তবু শহরটি ছিল উত্তরবঙ্গের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানে ছিল সাবডিভিশনাল অফিস, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত, থানা, উপকারাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, হোস্টেলসমেত উচ্চবিদ্যালয়, বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি এবং একটি নাট্যশালা। প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল- যেখানে নাট্যশালা, পাঠাগার ও বিদ্যালয় এক নতুন নাগরিক চেতনার জন্ম দেয়।
অর্থনৈতিকভাবে শহরটি ছিল প্রশাসনিক ও বিচারিক পেশাজীবীদের আধিক্যে পূর্ণ। মোক্তার, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারীরাই শহরের চালিকাশক্তি। শহরের বাজারকে ঘিরে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছিলেন, যাঁরা দেশীয় কাপড়, পাট, লবণ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় জনগণ সংখ্যায় অধিক হলেও শহরের অর্থনীতির চালকের আসনে ছিলেন বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মারোয়ারি অভিবাসীরা। তৎকালীন নীলফামারীতে দুটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ছিল- একটি ব্যাংকিং খাতে ও অন্যটি বাণিজ্যে। এ যেন ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত, যে শহরটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে পূর্ণ বিকশিত হয়নি, তবু তার মধ্যে ছিল শহর হয়ে ওঠার নীরব আকুতি। নীলফামারীর ইতিহাস কেবল একটি শহরের গড়ে ওঠার কাহিনি নয়, বরং এটি ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার কাঠামোয় কীভাবে একটি অঞ্চল নতুন পরিচয় পায়, তার জীবন্ত দলিল। শহরটি কখনো সৈয়দপুর কিংবা ডোমারের মতো বাণিজ্যিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। তবু এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, শিক্ষাগত কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশাসনিক অবকাঠামো একে এক স্বাতন্ত্র্যময় চরিত্র দেয়।
আজকের নীলফামারী শহরকে যদি আমরা দেখি, তবে তার মাঝে দেখতে পাই এক শতাব্দীজুড়ে বয়ে আসা পরিশ্রম, প্রতিরোধ, প্রশাসন ও সংস্কৃতির সম্মিলিত ছাপ। এখানকার মাটির নিচে রয়েছে নীল চাষের কষ্টগাথা, পুরানো আদালতের নথিপত্রে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতা আর জনমানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় সেই দিনগুলোর স্মৃতি- যেখানে নগর জন্ম নেয় এক ফাইলের নির্দেশে আর বেড়ে ওঠে হাজারো হাতের শ্রমে। এ শহরের জন্ম কেবল প্রশাসনিক প্রয়োজনের অনিবার্য ফসল নয়, বরং এক নথিভিত্তিক কল্পনা ও ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতার যুগলবন্দিতে গড়ে ওঠা এক সজীব প্রতিচ্ছবি। নীলফামারীর প্রতিটি ইট যেন বহন করে শতাব্দীপ্রাচীন একটি নীরব সংকেত; প্রতিটি গলি যেন একটি অদৃশ্য ইতিহাসের পথরেখা যেখানে পায়ে পায়ে জমে আছে কৃষকের ঘামের দাগ, আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি আর স্বপ্ন দেখার সাহসী মানুষের আত্মকথা। এখানে দালানকোঠার দেয়ালে, বিদ্যালয়ের শ্লেট-পড়া ছায়ায়, কোর্ট-কাছারির ধুলো জমা বারান্দায়- সবখানে ছড়িয়ে আছে সেই ঔপনিবেশিক ছোঁয়া, আবার জেগে আছে স্বাধীন স্বপ্নের দ্যুতি। নীল চাষের সেই গাঢ় ইতিহাস যেমন রক্তমাখা এক বর্ণগাথা, তেমনি মহকুমা সদরের নথিতে জন্ম নেওয়া প্রশাসনিক কাঠামোও একসময় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ।
এই হলো নীলফামারীর জন্মগাথা- এমন একটি গল্প, যেখানে নীল, নথি ও নগর এক ছন্দে, এক সুরে বাঁধা পড়েছে। এ গল্প কেবল শহরের নয়, এ গল্প মানুষের; এ গল্প রাষ্ট্রের, ভূগোলের, সময়ের ও স্বপ্নের। আমরা যারা এই শহরের সন্তান, আমরা শুধু এর বাসিন্দা নই- আমরা এই শহরের ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। আমরা সেই গানের উত্তরসূরি, যে গানে একান্ত সুরে মিশে আছে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস, জমিদারের ছায়া, ব্রিটিশ আমলার স্ট্যাম্প-করা ফাইল আর স্বাধীন মানুষের এক অনির্বচনীয় প্রত্যয়। নীলফামারী আমাদের কাছে শুধুই একটি নাম নয়- এ এক চলমান ইতিহাস, এক আত্মপরিচয়, এক আবেগ, যা সময়ের স্রোতে ভেসে চলে আবার মাটির গন্ধে ফিরে আসে বারবার, নতুন করে চিনিয়ে দেয়- আমরা কারা আর এই শহর আমাদের কতখানি আপন।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক
[email protected]
প্যানেল/মো.