ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প

নিজস্ব সংবাদদাতা, রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ১২:৪৫, ৪ জুলাই ২০২৫

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প

ছবি: জনকণ্ঠ

একসময় রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ও বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ভোরবেলা জেগে উঠত টুক টুক শব্দে—তাঁতের কাঠের সাঁড়াশির মতো মেশিনে তৈরি হতো গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি। শত শত পরিবার জীবিকা নির্বাহ করত এই হস্তচালিত তাঁতকে ঘিরে। তাঁত ছিল শুধু পেশা নয়, বরং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর স্বকীয় পরিচয়ের প্রতীক।

কিন্তু সময় বদলেছে, আর বদলে গেছে তাঁতির জীবন। এখন সেই টুকটাক শব্দ আর শোনা যায় না; তাঁত মেশিনের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে হাতে গোনা কয়েকটিতে। হাতে তৈরি তাঁতের পণ্যের চাহিদা যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে কাঁচামালের দাম। নেই সঠিক বিপণন ব্যবস্থা, নেই সরকারি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা—সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প।

পেশা বদলাচ্ছেন তাঁতিরা, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম
কালুখালীর বোয়ালিয়া ইউনিয়নের চরচিলোকা গ্রামের তাঁত শ্রমিক আতিকুল শেখ (৪২) বলেন,
“আমার দাদা-বাবা এই কাজ করতেন, আমি এখনও করছি। আগে চারটা গামছা বানালে ১৫০ টাকা আয় হতো, এখন ১০০ টাকাও হয় না। আগে গ্রামে ২০০ জন এ কাজ করত, এখন ৮-১০ জন। বাকিরা কেউ কৃষিকাজে, কেউ বিদেশে, কেউবা ভ্যান চালায়। আমরা বৈদ্যুতিক মেশিন কেনার সামর্থ্যও রাখি না—একটা মেশিনের দাম দুই লাখ টাকা।”

আরেক তাঁত শ্রমিক আজিবর মোল্লা (৪৫) বলেন, “এটা আমাদের জাতিগত পেশা। কিন্তু এখন ভালো নেই। একজন দিনমজুরও দিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় করে, আর আমরা ৩০০ টাকা। তার ওপর সুতা-রঙের দাম বেড়েছে। সরকার যদি একটু সহায়তা করত, তাহলে পরিবার নিয়ে চলতে পারতাম।”

প্রশাসনের উদ্যোগ : পুনরুজ্জীবনের আশ্বাস
কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহুয়া আফরোজ বলেন,
“তাঁতশিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। একসময় রাজবাড়ীর কালুখালীতেও তাঁতনির্ভর বড় একটি জনগোষ্ঠী ছিল। আমরা ইতিমধ্যে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যারা এখনও পেশায় জড়িত, তাঁদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা এবং বৈদ্যুতিক মেশিন কেনার জন্য সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “কালুখালী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁতশিল্প রক্ষায় ও এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা পরিকল্পনা করছি, যাতে এ শিল্পের পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয় এবং নতুন প্রজন্ম আকৃষ্ট হয়।”

একসময় যে তাঁতশিল্প ছিল জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন, আজ তা ধুঁকছে অস্তিত্ব সংকটে। প্রয়োজন সরকারি নীতিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন। না হলে একদিন হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে যাবে এই হাতের শিল্প—শুধু রয়ে যাবে স্মৃতি আর আফসোস।

মুমু ২

×