ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগে অনিয়মের পাহাড়, তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি

অপরাধ ঢাকতে নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে সিভিল সার্জনের সংবাদ সম্মেলনের চেষ্টা

নিজস্ব সংবাদদাতা, চুয়াডাঙ্গা

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:৫৩, ৪ জুলাই ২০২৫

চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগে অনিয়মের পাহাড়, তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি

ছবিঃ সংগৃহীত

চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগের স্তূপ জমছে। প্রশ্নফাঁসের গুঞ্জন, পরীক্ষার আগের রাতে কেন্দ্র বদল, অনুপস্থিত থেকেও ফল পাল্টে উত্তীর্ণ হওয়া এবং চূড়ান্ত ফলাফলে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন খোদ পরীক্ষার্থীরাই। অনিয়মের এই তুঘলকি কাণ্ডে হতবাক জেলার মানুষ। ভুক্তভোগীরা অবিলম্বে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ জুন চুয়াডাঙ্গার ১৯টি কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সহকারী পদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার ৩৯টি শূন্য পদের বিপরীতে ১৩ হাজার ৬৬৮ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। তবে পরীক্ষায় অংশ নেন ৪ হাজার ৮৭৪ জন।

এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করে।

সরোজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এক পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার চোখের সামনে আমি দেখেছি, আমার সামনে ও পেছনে বসা দুই পরীক্ষার্থী সেদিন পরীক্ষাই দেয়নি। অথচ ফল বেরোনোর পরে দেখি তাদের নাম উত্তীর্ণের তালিকায়! এটা কিভাবে সম্ভব? নিশ্চয়ই কোনো কারচুপি হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গার ছয়ঘরিয়া গ্রামের মেহেদী হাসান মুন্না জানান, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে যখন তিনি মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন জানতে পারেন তার সঙ্গে কী ঘটেছে। তিনি বলেন, আমাকে জানানো হয় আমি লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছি। কিন্তু ভাইভা দিতে গিয়ে দেখি আমার নাম বদলে অন্য একজনের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান আরেক ভুক্তভোগী সাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, ভাইভার লাইনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন নিজের কানে শুনেছি, একজন পরীক্ষার্থী দিব্যি ভাইভা দিচ্ছেন যিনি কিনা লিখিত পরীক্ষাতেই অংশ নেননি! এটা কী ধরনের প্রহসন?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরীক্ষার্থীর আরও অভিযোগ, পরীক্ষার আগের রাতেই তাদের হাতে পৌঁছে যায় প্রশ্নপত্র। শুধু প্রশ্ন নয়, সেই সঙ্গে উত্তরও দেওয়া ছিল। তাদের দাবি, সেই প্রশ্নপত্র মেনেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।

একজন পরীক্ষার্থী বলেন, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরে যখন সেই প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখলাম, বুঝলাম যে এটাই আসল প্রশ্ন। এরপর আর কিছু বলার থাকে না।

নিয়োগে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন অন্তর বিশ্বাস নামের স্থানীয় এক তরুণ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন তিনি। ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অন্তর বলেন, নিয়োগ নিয়ে এমন জালিয়াতি দেখে আমি স্তম্ভিত। আমি চাই, অবিলম্বে এর তদন্ত হোক এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।

এদিকে, অভিযোগ উঠেছে ভাইভা তালিকায় নাম না থাকা এক পরীক্ষার্থীকে একান্তভাবে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়ে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে। লিখিত অভিযোগে পরীক্ষার্থী মোছা. সুবর্ণা খাতুন (রোল নং: ২৪১৯১১০৫২২২) জানান, ভাইভার জন্য প্রকাশিত ২০৫ জনের তালিকায় রোল নং ১৮১৯৩৪০৩৩২৬৭ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরবর্তীতে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে ওই রোল নম্বর যুক্ত করা হয় বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করে। এরপর তাকে সবার শেষে একান্তভাবে ভাইভা নেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দাবি, এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও অনিয়মপূর্ণ। অপর এক পরীক্ষার্থী মো. সাজেদুর রহমান (রোল নং: ২৪১৯১১০৫৮২২) বলেন, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ১৮১৯৩৪০৩৩২৬৭ নম্বর রোলধারী প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত। ফলে আমি শুরুতে ভাইভা দিতে আগ্রহী ছিলাম না। পরে পরিবারের চাপে ভাইভা দিতে গেলে দেখি ওই মেয়েটি ভাইভা দিতে আসে, যদিও তালিকায় তার নাম ছিল না। তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, ভাইভার সময় একজন কর্মকর্তা ওই প্রার্থীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার জন্য তো আমাদের ফোন গরম হয়ে গিয়েছিল। পরে সবার শেষে তার ভাইভা নেওয়া হয় এবং তিনিই চাকরি পান। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।

অপরদিকে, ইকলাছ উদ্দীন নামে আরও এক প্রার্থী সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুসরণ না করে তার ওয়ার্ডের কোটা অন্য ওয়ার্ডের প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগে ইকলাছ উদ্দীন জানান, তিনি আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদী ইউনিয়নের ৩ নম্বর (পুরাতন) ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। তার রোল নম্বর ২৪১৯১১০২১৮৭। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে আবেদন করলেও একই ইউনিয়নের ১ নম্বর (পুরাতন) ওয়ার্ডের এক প্রার্থীকে (রোল ২৪১৯১১০৪৯১৩) ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সুপারিশ করা হয়েছে। যা ২০২৫ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৫ নম্বর শর্তের পরিপন্থী বলে দাবি তার।

তিনি আরও বলেন, আমি সঠিকভাবে আবেদন করেছি। আমার ওয়ার্ডে আসন থাকলেও অন্য ওয়ার্ডের একজনকে সেখানে সুপারিশ করা হয়েছে। এটা আমার প্রতি সরাসরি অবিচার। নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে অভিযোগের অনুলিপি জেলা প্রশাসক বরাবরও প্রেরণ করা হয়েছে।

তবে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন আহমেদ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এই নিয়োগ পরীক্ষা সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রশ্নফাঁস বা অন্য কোনো অনিয়মের কোনো সুযোগই ছিল না। আমরা সমস্ত নিয়মকানুন মেনেই পরীক্ষা নিয়েছি।

অন্যদিকে, স্থানীয় সূত্রে খবর, ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন আহমেদ-এর বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা তার বিরুদ্ধে ৭টি দুর্নীতির অভিযোগ লিখিত আকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, এই নিয়োগ পরীক্ষাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী প্রার্থীরা অবিলম্বে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। তারা চান, প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন দুর্নীতি করার সাহস না পায়। একই সঙ্গে, দ্রুত পুনরায় স্বচ্ছভাবে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

এদিকে, স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগের বিভিন্ন অনিয়মের খবর প্রকাশ ও প্রচার শুরু হয়। এরপর তা চাউর হয়ে শুরু হয় দেশব্যাপী তোলপাড়। এ ঘটনায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দীন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে অপরাধ ঢাকতে নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় সংবাদ সম্মেলন করানোর চেষ্টা করেন। এতে গণমাধ্যম কর্মীদের তোপের মুখে পড়ার আঁচ পেয়ে সংবাদ সম্মেলনটি শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয় বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।

ইমরান

×