
.
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে একের পর এক মব সৃষ্টিসহ ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, দখল-চাঁদাবাজি এখন নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে জনতা ঘেরাও করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। এ সময় তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। জুতা দিয়ে তাকে মারাও হয়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে উপদেষ্টা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নিন্দা জানিয়েছেন। মব নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ মাসে সারাদেশে ‘মব’ সৃষ্টি করে অন্তত ১৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ‘মব ভায়োলেন্সের’ বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলেও কার্যকর কোনো ফল হচ্ছে না। কথিত উত্তেজিত জনতার নামে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। যার সর্বশেষ শিকার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জুতা পেটা করতেও কুণ্ঠিত হননি মব সৃষ্টিকারীরা।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সব অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। যার সঙ্গে সন্ত্রাসীরা তো আছেই, জড়িয়ে পড়ছেন খোদ সরকারি কর্মকর্তারাও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। গত মে মাসেই সারাদেশে ঘটেছে ২ হাজার ৮০৯টি মারাত্মক অপরাধ। তার মধ্যে মব সৃষ্টির ঘটনাটি উদ্বেগজনক। এমন তথ্যই উঠে এসেছে খোদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিবেদনে।
গত ৯ মাসে রাজধানীতে ১৪৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চুরি, ছিনতাই ঘটনা ঘটে চলছে। কিছু ঘটনায় পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং লুণ্ঠিত মালামাল পুরোপুরি উদ্ধারও করতে পারছে না। এই ব্যর্থতাকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তবে দু-একটি ঘটনা ছাড়া সব মামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেছে ডিএমপি।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হকের মতে, দেশের পটপরিবর্তনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। জবাবদিহিতা, যথাযথ আইন প্রয়োগ না হলে, এর প্রবণতা বাড়বেই। অপরাধরোধে রাষ্ট্র তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। যেখানে অনিয়ম-অপরাধ ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা সমন্বয় করে অপরাধরোধে প্রতিনিয়তই কাজ করছে। সাবেক সিইসির এই ঘটনাটি দুঃখজনক।
গত ২৩ জুন গাজীপুর এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিস করা হয়েছে তা কাম্য নয়। তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ ধরনের ঘটনায় বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২৪ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, কোনো ধরনের মবকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। মব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। মব নিয়ন্ত্রণে কোনো পুলিশ সদস্যের গাফিলতি পাওয়া গেল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, মব তৈরি করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ছিনতাই-চাঁদাবাজি-ডাকাতির মামলা দেওয়া হবে।
গত ২৬ মে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক (কর্নেল স্টাফ) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলস কাজ করছে সেনাবাহিনী। ভবিষ্যতে জানমালের ক্ষতিসাধন, মব ভায়োলেন্স ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
গত ১০ জুন বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন উত্তর নামাপাড়া বোটঘাট এলাকার ক ২২৮/৬/১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা চাকরিজীবী মোহাম্মদ সহিদুল ইসলামের ফ্ল্যাটে মব সৃষ্টি করে হামলা, মারধর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ পরিচয় দিয়ে শিমুলের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আফজাল হোসেন মুক্তার, খালেক ও ইসমাইলসহ ২০ যুবক ওই ভবনে ঢুকে মব সৃষ্টি করে নগদ অর্থ ও অন্যান্য মূল্যবান মালামাল লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনারদিন শিমুলে নেতৃত্বে একদল যুবক পুলিশ প্রশাসনের পরিচয়ে নিজ ফ্ল্যাটে ঢুকে রুমে রুমে ঢুকে তল্লাশি চালায়। আসবাবপত্র তছনছ করে। পরে ঘর থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা লুটে নেয়। একই সঙ্গে ফ্ল্যাটের ২টি সিসিটিভি ও ডিভিআর খুলে নিয়ে যায়। এরপর বাকি টাকার জন্য ঘরে থাকা এটিএম কার্ডসহ তাদের গার্ড দিয়ে স্থানীয় একটি বুথে নিয়ে আরও ৫০ হাজার টাকা তুলে নেয়। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রাইম ব্যাংকের বাকি ৪ লাখ টাকার একটি চেক (চেক নম্বর-৪৬০৯৬৮৩) লিখিয়ে নিয়েছে।
গৃহকর্ত্রী কৌশলে মোবাইলে লুটপাটের ১ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ ধারণ করেন। পরে ১১ জুন রাতে তিনি খিলক্ষেত থানায় গিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। এ ব্যাপারে এসআই আজিজ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভিডিও ক্লিপের সূত্র ধরে গত ১৯ জুন দিবাগত মধ্যরাতে সন্দেহভাজন মব সৃষ্টিকারী আফজাল হোসেন মুক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদেরও ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
আসকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে মবের শিকার হয়ে মারা যান ৩২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬ জন, খুলনা বিভাগে ২ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭ জন, সিলেট বিভাগে ১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন, বরিশাল বিভাগে ১ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ২ জন। সরকার পতনের পর শুধু আগস্টে এক মাসেই দেশে মবের শিকার হয়ে ২১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি এ সংস্থাটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে মব সৃষ্টির মাধ্যমে হত্যার শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮০ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৬ জন, রংপুর বিভাগে ৭ জন, সিলেট বিভাগে ৫ জন, চট্টগ্রামে বিভাগে ২৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১৭ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ জন।
গত ১৯ মে মবের শিকার হয়েছেন এক প্রকাশক। সেদিন রাতে ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কে একজন প্রকাশককে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে তার বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেন একদল যুবক। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। পরে ওই ব্যক্তিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয় দিয়ে ওই প্রকাশককে গ্রেপ্তার করতে বলেন। এ সময় পুলিশ জানায়, ওই প্রকাশের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার অপারগতা প্রকাশ করে পুলিশ। পরে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈন্যু মারমার সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান তারা। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনজনকে থানা হেফাজতে নেয়। পরদিন ২০ মে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সবার ভূয়সী প্রশংসা পান ওসি। পেশাদারত্ব ও ধৈর্যের সঙ্গে ‘মব’ নিয়ন্ত্রণ করায় পরে ওই ওসিকে পুরস্কৃত করে ডিএমপি।
গত ১৪ জুন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে নগদের ডিস্ট্রিবিউটরের একজন প্রতিনিধির কাছ থেকে র্যাব পরিচয়ে ১ কোটি ৮ লাখ ১১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে টনক নড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। পরে ওই ভিডিও ক্লিপের সূত্র ধরে গত ১৮ জুন দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে এ ঘটনার জড়িত ৫জনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩৪ লাখ টাকা এবং ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে। উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃতরা র্যাব ও সেনা থেকে বহিষ্কৃত। তারা র্যাব পরিচয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
গত ২৬ এপ্রিল সিদ্ধেশ্বরীতে এক নারীকে টেনে-হিঁচড়ে তার ভ্যানিটিব্যাগ ছিনতাই করে প্রাইভেটকারে থাকা ছিনতাইকারীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনা ভাইরাল হলে সারাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু দুই মাসেও গ্রেপ্তার তো দূরের কথা শনাক্তই করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এতে ক্ষোভ জানান ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, দুই মাস হয়ে গেলে, এখনো এটার কোনো সুরাহা হয়নি। এমনকি এখন রাস্তাঘাটে কোনো নিরাপত্তা নেই।
গত ৩১ মে দারুস সালাম এলাকায় মাইকিং করে তানভীর ও ফাহিম নামের দুই তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। স্থানীয়সহ পুলিশের দাবি, নিহতরা মাদক কারবারি। এ কারণে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। পরদিন একই এলাকার রাস্তা থেকে রাসেল নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মারধরের একপর্যায়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার চেয়েছিলেন তোফাজ্জল। হত্যার আগে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তখন সামাজিক মাধ্যমে তৈরি হয় ব্যাপক সমালোচনা।
এর একদিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লা ক্যাম্পাসে উত্তেজিত লোকজনের পিটুনিতে হত্যার শিকার হন। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। সবশেষ গত ১৪ জুন রাতে গাজীপুরে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে চুরির অভিযোগে শাহরিয়ার রহমান নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এর আগেও ছিনতাইকারীদের অপরাধ সংঘটনের একাধিক ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারও করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আর আর্থিক খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে গত কয়েক মাসে কার্যকর উদ্যোগ দেখা গেছে যতটা, তার চেয়ে বেশি শোনা গেছে, কর্তাদের বাগাড়ম্বরতা। প্রতিমাসেই বাড়ছে ছোট-বড় নানা অপরাধ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা হওয়া মাঠ পার্যায়ের তথ্যসহ একটি প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে সেই ভয়াবহতা।
সরকারি তথ্য বলছে, গত মে মাসে সারাদেশে সংঘটিত হয়েছে ২ হাজার ৮০৯টি মারাত্মক অপরাধ। যা গত বছরের তুলনায় অন্তত ৫৬৪টি বেশি। আর সবচেয়ে বেশি অপরাধ ঘটেছে খোদ রাজধানীতে, ৫৮১টি আপরাধের ঘটনা নিয়ে শীর্ষে ঢাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম। এসব অপরাধ ঘটেছে মূলত রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ঘিরে। এর মধ্যে রয়েছে খুন, ধর্ষণ, জমি দখল, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হকের মতে, দেশের পট পরিবর্তনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। মব সৃষ্টি করে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে কিছু দুর্বৃত্তরা। এটি অচিরেই বন্ধ করা উচিত। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিপূর্ণ সক্ষমতা বা সক্ষমতার প্রশ্নে অতীতের অবস্থা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত মবকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। মব সৃষ্টির ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ জোরালো ব্যবস্থা নিতে না পারবে মব বন্ধ হবে না। ড. তৌহিদুল হক জানান, জবাবদিহিতা, যথাযথ আইন প্রয়োগ না হলে, অপরাধ প্রবণতা বাড়বেই। অপরাধরোধে রাষ্ট্র তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জানান, মব আসলে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সবাইকে অবগত করেছি যে, মব সৃষ্টি করে যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করা না হয়। আসলে মব তো কখনও জাস্টিস হতে পারে না, মব ভায়োলেন্স। তিনি জানান, সবাই যেন এ বিষয়ে সতর্ক থাকে। যে অপরাধ করে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। মবের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এআইজি সাগর জানান, মবের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় সতর্ক রয়েছে। পুলিশিং করা হয় যাতে এমন ঘটনা না ঘটে। কোথাও এ ধরনের ঘটনার খবর পেলে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়।
৫ আগস্টের পর এমন ২০টির বেশি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চাঞ্চল্যকর মামলায় আসামি ধরতে পারছে না পুলিশ। উদ্ধার করতে পারছে না লুণ্ঠিত আলামত। এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।
গত ২৩ জুন তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, পল্লবী ও খিলগাঁওয়ে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। গত ২৫ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট ৪নং রোডে সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের কার্যালয়ের বিপরীতে চায়ের দোকানে প্রকাশ্যে গুলি করে বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে হত্যা করা হয়। এখনো পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
১৩ মে তেজকুনি পাড়ায় বাসার পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশু রোজা মনি। পরে গরম পানি দিয়ে ঝলসানো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এক মাস হতে চললেও এ মামলার অগ্রগতি না থাকায় ক্ষুব্ধ রোজার মা। নিহত রোজার মা বলেন, ‘যেভাবেই পারেন, আমার মেয়ের খুনিকে আপনারা বের করে দেন।
১৬ জুন রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় একটি ভাড়া বাসা থেকে সুমি আক্তার (২৭) নামে এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে কথিত স্বামী রাসেল।
একই দিন রাজধানীর শাহবাগ শিশু পার্কের সামনে ফুটওভার ব্রিজের নিচে মোবারক নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
২৫ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে দিয়াবাড়ি সিটি কলোনি এলাকায় মিজানুর মিলন (২২) নামে এক পোশাক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যার করা হয়েছে। এই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ওইদিন পুরান ঢাকার বংশালে মাকসুদা খানম (২৬) নামে এক নারীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার করে পাষণ্ড স্বামী ইব্রাহিম। পরে পুলিশ ইব্রাহিম খানকে গ্রেপ্তার করে।
১১ জানুয়ারি গুলশানের বাসায় যৌথবাহিনীর পরিচয়ে এক বাসা থেকে ৬০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৩৪ লাখ টাকা লুট করা হয়। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক হলেও মূল আসামি ও লুণ্ঠিত মালামাল এখনো অধরা।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রীর ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে আনোয়ার হোসেন নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে তার কাছে থেকে ২০০ ভরি সোনা এবং এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দু’টি মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। ঘটনার পরপর ডাকাতির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
১৮ মে বিকেলে রাজধানীর মগবাজারের গ্রিনওয়ে গলিতে তিন ছিনতাইকারী আবদুল্লাহ নামে এক যুবকে চাপাতি কুপিয়ে তার কাছ থাকা টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ ভাইরাল হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।