ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স ডিগ্রি: যা জানা জরুরি

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ৪ জুলাই ২০২৫

অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স ডিগ্রি: যা জানা জরুরি

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় আসেন দেশটির অনন্য জীববৈচিত্র্য উপভোগ করতে এবং কাজ ও জীবনের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে। অস্ট্রেলিয়া এখন বাংলাদেশি তরুণদের উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে "ডাউন আন্ডার"-এ পড়াশোনা ও বসবাসের অভিজ্ঞতা আসলে কেমন?

এই প্রতিবেদনটি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার নানা দিক ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাঠকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে।

কেন অস্ট্রেলিয়া?
অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়—যার মধ্যে ৩৭টি সরকারি ও ৬টি বেসরকারি। এর পাশাপাশি ১৭০টির বেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোই আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চ মানের বলে বিবেচিত।

এছাড়া, দেশটি কাজের ক্ষেত্রেও উন্নত পরিবেশ প্রদান করে। অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের ওপর জোর দিয়ে থাকে। আবহাওয়া মনোরম হওয়ায় ও জীবনমান উন্নত হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

পশ্চিম সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি গ্র্যাজুয়েট ও বর্তমান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আনোয়ার ঘোষ বলেন, “আমি এমন একটি দেশ খুঁজছিলাম যেখানে পড়াশোনা ও বসবাস একসাথে ভালোভাবে করা যায়। এখানকার আবহাওয়া আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল। না তীব্র শীত, না গ্রীষ্মের গরম—একটা হালকা জ্যাকেটেই পুরো বছর কাটানো যায়।”

ভর্তি প্রক্রিয়া ও শর্তাবলি
অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করতে সাধারণত এক থেকে দুই বছর সময় লাগে। পিএইচডি সম্পন্ন করতে তিন বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। ভর্তি সাধারণত বছরে কয়েকটি ইনটেকে হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি ইনটেক সবচেয়ে জনপ্রিয়।

ভর্তি পেতে হলে সাধারণত সিজিপিএ ২.৫০ থেকে ২.৭৫ (৪.০০ স্কেলে) হলেই চলবে। তবে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ৩.০০ বা তার বেশি সিজিপিএ প্রয়োজন। ইংরেজি দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য IELTS-এ কমপক্ষে ৬.৫ স্কোর বা সমমানের অন্য কোনো টেস্ট লাগবে।

ভর্তির জন্য এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (EOI) বা স্টেটমেন্ট অব পারপাসও প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া, ভিসার জন্য GTE (Genuine Temporary Entrant), COE (Confirmation of Enrolment), ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও স্পন্সরের যাচাইকৃত সম্পত্তির বিবরণ লাগবে।

কোন বিষয়ে পড়া ভালো?
অস্ট্রেলিয়ান হোম অ্যাফেয়ার্স বিভাগের তালিকা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষকতা, আইটি, নির্মাণ, প্রকৌশল ও আতিথেয়তা খাতে দক্ষ পেশাজীবীর চাহিদা অনেক বেশি।

মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাঈদ আবদুল্লাহ বলেন, “অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষকের খুব অভাব। তাই আমি শিক্ষকতাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি।”

আনোয়ার ঘোষ বর্তমানে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল ওয়ার্কে দ্বিতীয় ব্যাচেলর করছেন, কারণ এই বিষয়ে চাহিদা অনেক বেড়েছে।

ব্যয় ও বৃত্তির সুযোগ
অস্ট্রেলিয়ায় দুই বছরের মাস্টার্স করতে খরচ পড়তে পারে AUD ৪৪,০০০ থেকে AUD ১,০০,০০০ পর্যন্ত। এ ছাড়া, বসবাসের জন্য বছরে প্রায় AUD ২০,০০০ থেকে AUD ২৫,০০০ দরকার হতে পারে, যা নির্ভর করে জীবনযাপন ও আবাসনের ধরন অনুযায়ী। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন ফি হিসেবে AUD ১০০ থেকে AUD ২০০ নন-রিফান্ডেবল ফি নিয়ে থাকে।

এই অবস্থায় একটি বৃত্তি শিক্ষার্থীর জন্য অনেকটা স্বস্তি এনে দিতে পারে। ফারিহা কবির, মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট বলেন, “বৃত্তির কারণে আমার মাস্টার্স অনেক সহজ হয়ে গেছে। এমনকি পিএইচডিতে পূর্ণ তহবিল পাওয়াও সম্ভব হয়েছে।”

তবে অধিকাংশ বৃত্তি অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং ১০০ শতাংশ তহবিল পেতে হলে খুব ভালো একাডেমিক রেজাল্ট ও দক্ষতা থাকতে হয়।

চ্যালেঞ্জ: বাসস্থান ও চাকরি
অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো বাসস্থান এবং চাকরি।

মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সিদরাতুল ওইসুর্জো বলেন, “বাসা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। প্রচুর কাগজপত্র জমা দিতে হয়। রুমমেট নিয়ে শেয়ার হাউজে থাকা যায়, তবে ছাত্রাবাস অনেক ব্যয়বহুল।”

বাড়ি ভাড়ার জন্য পূর্বের ভাড়া ইতিহাস, ইনকামের প্রমাণ ও সুপারিশপত্র প্রয়োজন হয়। ফলে নতুনদের জন্য ঘর খোঁজা বেশ কষ্টসাধ্য।

অন্যদিকে, চাকরি পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পড়াশোনার সময় শিক্ষার্থীরা প্রতি দুই সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন এবং প্রতি ঘণ্টায় প্রায় AUD ২০ থেকে AUD ২৫ উপার্জন করতে পারেন।

ম্যাককোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী ফারিয়া হোসেন বলেন, “আমি দিনে দুটি পার্টটাইম চাকরি করি। অনলাইন সাইট ছাড়াও হাঁটাহাঁটি করে দোকানে সিভি দিয়ে চাকরি খুঁজেছি।”

অস্ট্রেলিয়ায় কাজ ও জীবনের বাস্তবতা অনুধাবনের ওপর জোর দিয়ে সাইয়েদ রাকিব হাসান বলেন, “বাংলাদেশে যেটা তুচ্ছ মনে করি, সেটাই এখানে ভালো আয়ের উৎস হতে পারে। চাকরি পাওয়ার একমাত্র প্রতিবন্ধকতা হলো মানসিক প্রস্তুতির অভাব।”

প্রস্তুতি ও মনোভাবের গুরুত্ব
সঠিক প্রস্তুতি, ইতিবাচক মানসিকতা এবং নতুন অভিজ্ঞতার প্রতি আগ্রহ থাকলে অস্ট্রেলিয়া শুধুমাত্র শিক্ষার গন্তব্য নয়—বরং জীবন গঠনেরও এক বড় সুযোগ হতে পারে।

মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফারিহা বলেন, “মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন, বন্ধু তৈরি করুন। যোগাযোগ ও স্মার্ট কাজ অনেক দরজা খুলে দিতে পারে।”

ফারিয়া বলেন, “অস্ট্রেলিয়া আপনাকে স্বাধীনতা দেয়, কিন্তু সেই স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বও আসে।”

আনোয়ার বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করুন, বন্ধু তৈরি করুন। হাজার কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনাই আপনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।”

সূত্রঃ www.thedailystar.net

নোভা

×