
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্ট—এই দুই মাসে নওগাঁ জেলার রাজপথ, শিক্ষাঙ্গন এবং জনমনে গড়ে উঠেছিল এক বিরল গণআন্দোলনের ঢেউ, যা পরে জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পথ উন্মোচন করে দেয়। নওগাঁর শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, নারী এবং সাধারণ মানুষদের অংশগ্রহণে এই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে সারাদেশব্যাপী প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি।
জুলাই অভ্যুত্থান পাল্টে দেয় সব হিসাব-নিকাশ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও সরকারের দমন পীড়ন, হত্যা, নির্যাতনে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
জুলাই: ক্রমাগত ক্ষোভ থেকে প্রতিরোধের সূচনা, ২০২৪ সালের জুলাই মাসজুড়ে দেশের ন্যায় নওগাঁতেও সাধারণ মানুষ সরকারের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে।
৩ জুলাই নওগাঁ সরকারি কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এবং বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে মুক্তির মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল—নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
পরবর্তী দিনগুলোতে শিক্ষক, দোকানি, দিনমজুর, স্বেচ্ছাসেবী, এমনকি কৃষকরাও আন্দোলনে অংশ নেন। ৫ জুলাই একটি বিশাল পদযাত্রায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হন।
৬–১২ জুলাই শহরজুড়ে হরতাল, সড়ক অবরোধ, টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং পোস্টার-লিফলেট বিতরণ চলতে থাকে। ৮ জুলাই প্রশাসনের সঙ্গে সংলাপ শুরু হলেও ছাত্র-জনতা তাতে সন্তুষ্ট হয়নি।
১৩–২০ জুলাই নওগাঁ ঢাকায় চলমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’
এই স্লোগানটি ১৪–১৫ জুলাই ২০২৪ সালের সময়ে নওগাঁসহ সারাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের চোখে সামনে থেকে দাবি তুলে ধরেছিল, যখন শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রতিবাদে তারা ‘রাজাকার’ শব্দটি পুনরায় ব্যবহার করছিল ‘সারা দেশের সাথে একযোগে নওগাঁ’ স্লোগানটি আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করে। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি রিকশাচালক, হকার, দোকানদার, নারীরাও বিক্ষোভে যুক্ত হন।
আগস্ট: দমন-পীড়ন আর সংঘর্ষের মুখোমুখি আন্দোলন
১ আগস্ট আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে প্রস্তুতি চলছিল। ২ আগস্ট প্রশাসন মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ ঘোষণা করে।
আন্দোলন চলাকালীন দেশব্যাপী যখন নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছিল তখন ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনা সরকার ও তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সারাদেশের ন্যায় ৩ আগস্ট একযোগে ১ দফার দাবিতে শহরের কাজীর মোড়, সরিষাহাট মোড়, মুক্তির মোড় ও রুবির মোড় সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন, পুলিশের অতিরিক্ত এসপি ও এক সাংবাদিক আহত হন বলে জানা যায়। পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে।
৪ আগস্ট সকালে সড়ক অবরোধ করা হয় কাজীর মোড় থেকে এটিম মাঠ পর্যন্ত। ‘জেগেছে রে... ছাত্র-জনতা জেগেছে’—এই স্লোগানে শহর প্রকম্পিত হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা জেলা প্রশাসকের পদত্যাগ দাবি করেন।
৫ আগস্ট সারাদেশেই চলছিল কঠোর অবরোধ, নওগাঁতেও প্রতিবাদ থামেনি। শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কঠোরভাবে মাঠে ছিল—লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং এবং স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নওগাঁতে ৯ জন শহীদ এবং ৬৩ জন আহত হন।
নেতা-কর্মীদের কণ্ঠে আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি
আন্দোলনের সংগঠক আরমান হোসেন বলেন, “আমরা শুধু অধিকার চেয়েছিলাম, অথচ পুলিশ ও কিছু দুর্বৃত্ত আমাদের গায়ে হাত তুলেছিল। সেই স্লোগান আজও কানে বাজে। ওই দিনগুলোর কথা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শুধু অধিকার চেয়েছিলাম, অথচ পুলিশ ও কিছু দুর্বৃত্ত আমাদের গায়ে হাত তুলেছিল। মনে আছে, কাজীর মোড়ে যখন সবাই একসাথে চিৎকার করছিল—‘বৈষম্য মানি না’, তখন মনে হচ্ছিল, আমরা সত্যিই বদল আনতে পারি। আজও কানের ভেতর বাজে সেই স্লোগান… আজও বুক ধড়ফড় করে সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময়টা মনে করলে।”
আন্দোলনের ছাত্রনেতা সাদনান সাকিব বলেন, ‘আমি বুঝিনি, আমরা ইতিহাসের অংশ হচ্ছি। ডিসির অপমানজনক মন্তব্যের প্রতিবাদে যখন হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে—তখন মনে হয়েছিল, আমাদের কণ্ঠস্বর শেষমেশ শোনা যাচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে একসাথে লড়েছি—এই স্মৃতি জীবনভর বয়ে বেড়াব।’
আরেক সংগঠক ফজলে রাব্বি বলেন, “শুধু রাস্তায় দাঁড়ানো নয়, এটা ছিল বুকের ভেতর থেকে আসা প্রতিবাদ। ডিসি, পুলিশ—সবাই আমাদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি আজও মনে করি, সেই তিন দিন (৩-৫ আগস্ট) নওগাঁর মানুষ সবচেয়ে বেশি জেগে ছিল। কেউ ভীত ছিল না, কেউ পিছু হটেনি। একাত্তরের চেতনাই যেন নতুন করে জেগেছিল।’
সাবিহা তাসনিম (শিক্ষার্থী, সরকারি কলেজ নওগাঁ) বলেন, ‘সেদিন আমরা নারী হয়েও পিছিয়ে যাইনি। আমাদের হাতে ছিল না কোনো লাঠি, শুধু ছিল সাহস আর দাবি—সমান অধিকার। যখন দেখি আমার বান্ধবীরা কাঁদছে তবুও স্লোগান দিচ্ছে, তখন বুঝি—এই দেশ বদলাবে, বদলাতে হবেই। এখনো রাতে ঘুমাতে গেলে কাজীর মোড়ের মাইক আর কণ্ঠগুলো কানে বাজে।’
হাসিব চৌধুরী (আন্দোলন সংগঠক) বলেন, ‘আমরা যারা মাঠে ছিলাম, তারা জানতাম না কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস ছিল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানেই সঠিক পথে থাকা। আজ যখন সবাই যার যার জায়গায় ফিরে গেছে, আন্দোলন থেমে গেছে, তখন এই স্মৃতি জ্বলজ্বলে থেকে যায়—তীব্র রোদে, জলভেজা রাতে, স্লোগানে আর চোখের জলে গাঁথা হয়ে।’
রিজভী আহম্মেদ (আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক) বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (নওগাঁ ব্লাড সার্কেল) পোস্টার ছাপিয়েছি, পত্রিকা বিলিয়েছি, রাতে নিঃশব্দে শহরে লিফলেট ছড়িয়েছি। কেউ নাম জানে না, কেউ চেনে না, তবু আমরা ছিলাম, আছি। আন্দোলন শুধু মিছিল নয়—আন্দোলন একটা মনোভাব। সেটা নওগাঁর প্রতিটি গলিতেই ছড়িয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও আমাদের সাথে নওগাঁর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যুক্ত হয়ে আমরা এক যোগে কাজ করেছি।’
একটি জেলা, একটি চেতনার নাম নওগাঁ, নওগাঁ জেলার সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ছাত্র ইউনিয়ন, স্বেচ্ছাসেবী, যুব ফোরামসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। নারী অংশগ্রহণ ছিল ব্যতিক্রমী।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটি যুগান্তকারী গণপ্রতিরোধের নাম, যার অংশ হিসেবে নওগাঁ জেলার জনগণ সাহসিকতা ও ঐক্যের মাধ্যমে ইতিহাসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, যখন জনগণের অধিকার হরণ করা হয়, তখন তারা সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জানে। নওগাঁ যে ভূমিকা রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এই অভ্যুত্থান মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণবিক্ষোভ ছিল এবং এর ফলস্বরূপ শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে পলায়ন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এটি প্রমাণ করে, যখন জনগণের কণ্ঠরোধ করা হয়—তখন তারা সংগঠিত হয়ে জবাব দিতে জানে। নওগাঁ সেই জবাবদিহির এক নির্ভীক নাম।
রাকিব