
গতকাল ৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার ছুটির দিনে রাজধানীর মেট্রোরেলে প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি ভিড় ছিলো। গন্তব্যে ছুটে চলা নানা বয়সের যাত্রীদের মুখে ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা, কিংবা প্রতীক্ষার ছায়া। এই ভিড়ের মধ্যেই ঘটে গেল এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা, যা একদিকে যেমন হঠাৎ আতঙ্কের জন্ম দেয়, অন্যদিকে মানবিকতা ও সহানুভূতির উজ্জ্বল নিদর্শন স্থাপন করে।
রাজধানীর টিএসসি স্টেশনে মেট্রোলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন এক বয়স্ক বাবা ও তার ছোট্ট মেয়ে। গন্তব্য কাজীপাড়া। যথারীতি ট্রেন আসলো কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। হঠাৎ করেই ভিড়ের চাপে মেয়েটি ট্রেনে উঠে পড়ে, কিন্তু তার বাবা উঠতে পারেন না। দরজা বন্ধ হয়ে যায় মুহূর্তেই। ট্রেন ছুটে চলে—আর ছোট্ট মেয়েটি ছটফট করে।
প্ল্যাটফর্মে তখন মেয়েটির বাবার মুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি একবার প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকান, একবার ট্রেনের শেষ অংশের দিকে। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। সেই অসহায় মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়ানো এক তরুণ এগিয়ে আসেন।
নাম তার শাকিল। সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী। যিনি নিজেও ওই মেট্রোরেলে উঠতে পারেননি। তিনি জানান, “আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটির বাবা ট্রেনে উঠতে পারেননি, আর মেয়েটি একা ভিতরে আটকা পড়েছে। মুহূর্তেই মাথায় আসে, আমার পরিচিত নাহিদ ভাই সেই ট্রেনেই উঠেছেন—উত্তরার উদ্দেশ্যে।” দ্রুত নাহিদ ভাইকে ফোন করে মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে বলেন তিনি।
ঘুরে ঘুরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে নাহিদ ভাই মেয়েটিকে দেখতে পান। এরপর ভিডিও কলে মেয়েটিকে তার বাবার সাথে কথা বলানো হয়। মেয়েটির কান্না তখন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসে, বাবার কণ্ঠ শুনে একটু আশ্বস্ত হয়। ঠিক তখনই পরবর্তী মেট্রোরেল ধরে মেয়েটির বাবাকে নিয়ে রওনা হন ওই তরুণ। কাজীপাড়া স্টেশনে পৌঁছেই দেখা হয় মেয়েটির সঙ্গে—আর তখনই সেই দৃশ্য, যা উপস্থিত সবাইকে আবেগে আপ্লুত করে তোলে।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটি। কান্না ও হাসির মিশ্র অনুভূতিতে মেয়েটি তখন নিঃশব্দে কাঁপছে। পাশ থেকে মেয়েটির বাবা কাঁপা গলায় বলেন, “আমার এক ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি, আর আজ যদি মেয়েটাকেও হারিয়ে ফেলতাম... কী হতো তখন! আল্লাহ মাফ করছে। আপনাদরের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেই তরুন (শাকিল) জনকণ্ঠকে বলেন, “মেয়েটার হাসি দেখে নিজের ভেতরে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করলো। আমি হেসে ফেললাম। বুঝলাম, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটাও বড় দায়িত্ব।” তিনি আরও জানান, ঘটনার সময় তার সাথে সুমন ভাই, সাথী আপু ও শাহেদ ভাই ছিলেন, যারা পাশে থেকে সহায়তা করেছেন।
একটি ছোট ভুল মুহূর্তেই বদলে দিতে পারতো একটি পরিবারের চিরন্তন সুখ। কিন্তু শাকিল, নাহিদের মতো সচেতন ও মানবিক তরুণদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও সংহতির কারণে ঘটে গেল একটি আনন্দময় সমাপ্তি। মেয়েটির মুখের হাসিই যেন বলে দেয়—মানবিকতাই এই শহরের সবচেয়ে বড় শক্তি।
রাজু