ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য: কুমিল্লায় ধ্বংসের মুখে ২০০ বছরের বাঁশ-বেত শিল্প

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৩:৪৩, ৫ জুলাই ২০২৫

হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্য: কুমিল্লায় ধ্বংসের মুখে ২০০ বছরের বাঁশ-বেত শিল্প

একসময় কুমিল্লার প্রতিটি জনপদে বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাব, গৃহস্থালি সামগ্রী আর সৌখিন পণ্য ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন সময় বদলেছে, আর সেই সাথে বদলে গেছে দৃশ্যপট। প্লাস্টিক আর আধুনিক যন্ত্রের বাজার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ-বেত শিল্প। এক সময় যে শিল্পে জীবিকার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল শত শত পরিবার, আজ তারাই দু’মুঠো ভাতের জন্য লড়ছেন প্রতিদিন।

মুরাদনগরের আমপাল, পায়ব ও দেবীদ্বারের পুনরা, বিহারমন্ডল ও মোহাম্মদপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে — গুটি কয়েক পরিবার এখনো বাপ-দাদার পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে লাভের পরিবর্তে লোকসানই যেন তাদের নিয়তি।

দেবীদ্বারের দক্ষিণ পুনরা গ্রামের ৬৫ বছরের কারিগর খোকন মিয়া বলেন, "প্লাস্টিকের পণ্যে বাজার সয়লাব। বাঁশের দাম বেশি, খরচ বাদ দিলে দিনে ২০০-২৫০ টাকা লাভ হয়। এত সামান্য আয় দিয়ে বেঁচে থাকা দায়!"দক্ষিণ পুনরার প্রবীণ মোবারক হোসেন, সাহেব আলীসহ একাধিক কারিগর জানান, তাদের পেশার বয়স প্রায় দুই শতাব্দী। এক সময় পুরো গ্রামের সবাই এ পেশায় থাকলেও এখন সীমিত হয়ে এসেছে মাত্র ৪০-৫০ পরিবারে। অনেকেই পেশা বদলে নিয়েছেন বা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।

টুকরিসহ নানা গৃহস্থালী পণ্যের জন্য আগে গ্রামে ছিল বড় চাহিদা। কিন্তু এখন মাটি কাটার কাজে শ্রমিকের বদলে ভেকু ও ড্রেজার ব্যবহারের ফলে সেই চাহিদা একেবারে নেই বললেই চলে। প্লাস্টিকের সস্তা ও টেকসই পণ্যে ক্রেতারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাঁশ-বেতের দিক থেকে।

কাতার প্রবাসী মো. মাসুম বলেন, “এক দিনে ১০টা মাছের টুকরী বানাই। খরচ বাদে হাতে থাকে মাত্র ২০০ টাকা। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশে আসতে বাধ্য হয়েছি।”

এইচএসসি পাশ করা আ. কাদের বলেন, "শুধু ঐতিহ্যের টানে টিকে আছি। সুযোগ পেলে আমিও অন্য পেশায় চলে যাব।"

দেবীদ্বার ও মুরাদনগরের বাজারে বাঁশ-বেতের পণ্য বিক্রি করতে আসা কারিগরদের কণ্ঠেও একই সুর — “বাঁশের সংকট, প্লাস্টিকের দাপট আর আয়ের অভাবে এ পেশায় থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে।”নারী সাংবাদিক ও আজকের কথা পত্রিকার প্রকাশক ফাহিমা বেগম প্রিয়া বলেন, “প্রতিদিন তারা কাজিয়াতল, পরমতলা, ধামঘরসহ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাঁশ-বেতের পণ্য ফেরি করেন। যা বিক্রি হয়, তা দিয়েই খাবার কিনে বাড়ি ফেরেন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে এই পেশায় টিকে থাকাই বিশাল চ্যালেঞ্জ।”

আগে বাড়ির ঝাঁর থেকেই কেটে বানানো হতো খাড়ি, মোড়া, দোলনা, চাটাই, ধামা প্রভৃতি পণ্য। এখন এসব শুধু গ্রামীণ মেলাতে কদাচিৎ দেখা মেলে। নতুন প্রজন্ম তো অনেকেই এসব চিনেই না।সবকিছু মিলিয়ে আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে একটি শিল্পের অস্তিত্ব। একদিকে কারিগরদের জীবিকা সংকটে, অন্যদিকে জাতি হারাতে বসেছে নিজেদের শতবর্ষের ঐতিহ্য।

সচেতন মহল মনে করছেন— বাঁশ-বেত শিল্প রক্ষায় চাই রাষ্ট্রীয় সহায়তা, কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং পণ্য বিপণনে প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা।

 

রাজু

×