
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির নানা খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। তেমনি বহুল আলোচিত দুর্নীতিগ্রস্ত একটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ ছাড়ের অনৈতিক চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
এ চেষ্টার অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) চিঠি দিয়ে তদন্ত না করার অনুরোধের কথা জানা যায়। দুর্নীতিগ্রস্ত ওই প্রকল্পের জন্য আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নির্ধারিত অর্থ ছাড়ে সহায়তার অনুরোধ করা হয়েছে একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বিষয়টি নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আলোচিত ছিল বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি (বিটিসিএল) কর্তৃক গৃহীত ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্প। প্রায় ৩২৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আভ্যন্তরীণ একটি বৈঠকে প্রকল্পের টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার আহবানের সিদ্ধান্ত দেন সাবেক মন্ত্রী। সাবেক সচিব সেই সিদ্ধান্ত উপক্ষো করে মাত্র এক দিনের নোটিশে বিটিসিএল এর বোর্ড সভা ডেকে, একই দিনে আর্থিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে সেই দিনই কার্যাদেশ দেন।
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পে নজিরবিহীন অনিয়মের তদন্তে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রিপোর্ট জমা দেয়।
তথ্যানুসন্ধানে সেই তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রিপোর্টে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক একজন সচিব (পদাধিকার বলে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন) তার বিরেুদ্ধে অনিয়মের সরাসারি প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে অনিয়মের মাত্রা গুরুতর এবং নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন উপেক্ষা করে ২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার প্রকল্পে সক্ষমতা ১২৬ টেরাবাইট উল্লেখ করে প্রকল্পে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বিটিসিএলের বোর্ড সভা ডাকাসহ দরপত্র মূল্যায়ন থেকে কার্যাদেশ দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে অনিময় করা হয়েছে এবং কোম্পানি বিধি লংঘন করা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্তে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বিটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলা হয়। দুটি বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে অনিয়মের মাধ্যমে প্রভাবিত করার প্রমাণও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ার পর থেকেই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা সেটি গোপন করতে উঠে পড়ে লাগেন এবং দূর্নীতি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেননি।
জানা যায়, গত ২১ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে দুদকের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে তদন্তকালীন সময়ে ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চূড়ান্ত বিল পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানানো হয়। এর জবাবে গত ১৮ জুন দূর্নীতি দমন কমিশন থেকে জানানো হয়, দুদকের অনুসন্ধানী দল এরই মধ্যে এ প্রকল্পে অনিয়ম ও দূর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া খোদ বিটিসিএলের আইনজীবী মতামত দিয়ে জানিয়েছেন, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমতাবস্থায় তদন্ত চলাকালে এ প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে এবং অর্থ ব্যয় করা হলে তা আইনসিদ্ধ হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়।
দুদকের এই জবাবের পর আলোচিত দূর্নীতিগ্রস্ত এ প্রকল্পের অর্থ ছাড় করার অনুমতির জন্য গত ২২ জুন দুদক বরাবর ডিও লেটার দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব। তিনি ওই ডিও লেটারে লিখেছেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে ফাইভজির রেডিনেস পিছিয়ে পড়া রোধ, প্রযুক্তিগতভাবে বিটিসিএল এর পিছিয়ে পড়া রোধ, এডিপি বাস্তবায়ের হার নিশ্চিত করা এবং প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিটিসিএল এর অপর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে স্থাপিত যন্ত্রপাতি চালু করার লক্ষ্যে বিটিসিএল এর ফাইভজি উপযোগিকরনে বিটিসিএল এর অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার মনযোগ ও সহায়তা কামনা করছি।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফাইভজি চালু হলে দেশে আগামী এক যুগের মধ্যে ডাটার ব্যবহার সরোর্চ্চ ২৬ টেরাবাইটে দাঁড়াতে পারে বলে বুয়েটের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আর বর্তমানে দ্রুত প্রযুক্তির বিবর্তন হচ্ছে এবং আগের প্রযুক্তি বাতিল হচ্ছে। এ কারনে পাঁচ বছর সময়ের বেশী একটি প্রযুক্তির কার্যকারিতা বিবেচনা করেই বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি স্থাপন ও প্রযুক্তি হালনাগাদ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়। কিন্তু বিটিসিএলের ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের ক্ষেত্রে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতা এবং ১২ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ সময় ধরা হয়েছে যা অযৌক্তিক এবং অবাস্তব। শুধুমাত্র প্রকল্পের ব্যয় দশ গুন বাড়ানোর জন্যই অতিরিক্ত সক্ষমতা এবং ১২ বছর রক্ষণা-বেক্ষণ সময় ধরা হয়েছে। কোন যন্ত্রপাতি ১২ বছর চলবে কি’না তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করার দাবিও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ঠিক নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে প্রকল্পের চটকদার নাম দিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হত শুধুমাত্র লুটপাটের জন্য। ফাইভজি রেডিনেস সে ধরনেরেই একটি প্রকল্প। তাছাড়া বিটিসিএল এরই মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে একাধিক টেলিকম অপারেটরের জন্য ফাইবার নেটওয়ার্ক নির্মাণ করে দিয়েছে।
আসিফ