ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

খালি পেটে লেবুপানি, আসলেই কতটা উপকারী?

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৫ জুলাই ২০২৫

খালি পেটে লেবুপানি, আসলেই কতটা উপকারী?

ছ‌বি: প্রতীকী

খালি পেটে লেবুপানি খাওয়ার অভ্যাস এখন অনেকের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন কিংবা সকালের রুটিনে স্বাস্থ্যকর কিছু যোগ করতে চান, তাদের মধ্যে এই অভ্যাসটি বেশ জনপ্রিয়। টিকটক, ইউটিউব, কিংবা স্বাস্থ্য-বিষয়ক ওয়েবসাইট— সব জায়গাতেই দেখা যায় লেবুপানির প্রশংসা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, খালি পেটে লেবুপানি খাওয়ার পেছনে যে দাবি করা হয়, যেমন ওজন হ্রাস, হজমে সহায়ক, লিভার পরিষ্কার করা ইত্যাদি, সেগুলো কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য? আসলেই কি এটি অতটা উপকারী, নাকি কেবল একটা স্বাস্থ্যগত ‘ট্রেন্ড’?

লেবুতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ও ক্ষারধর্মী উপাদান, যা শরীরের জন্য উপকারী হতে পারে। সকালে খালি পেটে এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে অর্ধেক একটি লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে শরীর সতেজ বোধ করতে পারে এবং দিনের শুরুটা হয় হালকা। অনেকেই দাবি করেন, এটি তাদের হজম প্রক্রিয়া উন্নত করেছে, গ্যাস্ট্রিক কমেছে, এমনকি ত্বকও পরিষ্কার দেখায়। তবে এই দাবি কতটা বাস্তব, সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।

প্রথমত, লেবুপানি শরীরে হাইড্রেশন বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমরা অনেকেই রাতে ঘুমানোর সময় শরীর থেকে তরল হারাই, যার ফলে সকালে জেগে ওঠার পর শরীর কিছুটা ডিহাইড্রেটেড থাকে। খালি পেটে পানি খাওয়া সেই তরল ঘাটতি পূরণ করে। আর যদি সেই পানিতে লেবু মেশানো হয়, তাহলে কিছুটা স্বাদ যোগ হয় এবং লেবুর অল্প কিছু উপকারী উপাদানও শরীরে যায়। তবে এখানে গুরুত্বপূ্র্ণ হলো—পানিটিই মূলত উপকার করে, লেবু নয়। অর্থাৎ, শুধু পানি খেলেও একই হাইড্রেশন পাওয়া যায়, যদিও লেবু সামান্য অতিরিক্ত ভিটামিন যোগ করে।

দ্বিতীয়ত, লেবুতে থাকা ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাদের ঠান্ডা-কাশির প্রবণতা বেশি, তাদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে। তবে এটা মাথায় রাখা দরকার যে, এক গ্লাস লেবুপানিতে যেটুকু ভিটামিন সি থাকে, তা মোট চাহিদার তুলনায় খুবই অল্প। তাই এটিকে প্রতিদিনের মূল ভিটামিন সি উৎস হিসেবে ধরা ঠিক নয়। বরং নানা রকম ফলমূল ও সবজির মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করাই ভালো।

তৃতীয়ত, লেবুপানি শরীরের অম্ল-ক্ষার ভারসাম্য ঠিক রাখে—এই দাবি অনেক সময় করা হয়, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এটি অনেকটাই বিতর্কিত। লেবু স্বাদে টক হলেও শরীরে প্রবেশ করার পর তা বিপাক প্রক্রিয়ায় ক্ষারধর্মী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে শরীরের পিএইচ ভারসাম্য খুব নির্দিষ্ট একটি সীমায় কাজ করে এবং তা খুব সহজে পরিবর্তিত হয় না। তাই লেবুপানির মাধ্যমে শরীর "ডিটক্স" বা ক্ষারীয় করে ফেলার ভাবনাটি অতিরঞ্জিত। মানুষের লিভার, কিডনি ও ত্বক প্রাকৃতিকভাবেই ডিটক্সিফিকেশন করে, এবং এর জন্য আলাদা কোনো পানীয় বা রসের প্রয়োজন পড়ে না।

চতুর্থত, ওজন কমানোর ক্ষেত্রে লেবুপানিকে খুবই কার্যকর মনে করা হয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এটি ফ্যাট গলাতে সাহায্য করে। বাস্তবে লেবুপানি কোনো জাদু পানীয় নয়। তবে সকালে খালি পেটে এটি পান করলে আপনি কিছু সময়ের জন্য পেট ভরা অনুভব করতে পারেন, ফলে অতিরিক্ত খাওয়া কমে যেতে পারে। আবার যদি এতে মধু যোগ করা হয়, তবে তা ক্যালরি বাড়িয়ে দেয়, যা ওজন কমানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মূলত, ওজন কমানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও শরীরচর্চা। লেবুপানি এই প্রচেষ্টার সামান্য একটি সহায়ক মাত্র হতে পারে।

লেবুপানি হজম শক্তিতে সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে যারা সকালে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। উষ্ণ পানিতে লেবু মেশালে তা অন্ত্রকে সক্রিয় করতে পারে, ফলে মলত্যাগে সহায়ক হয়। তবে এটি সবার ক্ষেত্রে কার্যকর নাও হতে পারে এবং নিয়মিত লেবুর অম্ল শরীরের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যাদের গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের সমস্যা আছে। লেবুর টক অম্ল দীর্ঘদিন খালি পেটে খেলে পাকস্থলির দেয়ালে জ্বালাভাব, অম্বল বা এমনকি গ্যাস্ট্রিকের আশঙ্কা বাড়তে পারে।

এছাড়া একটি গুরুতর দিক হলো দাঁতের এনামেল ক্ষয়। লেবুর অম্ল দাঁতের উপরিভাগে আঘাত হানতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি সকালে এটি পান করার পরপরই দাঁত ব্রাশ করেন। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন, লেবুপানি পান করার পর কিছু সময় অপেক্ষা করে ব্রাশ করা উচিত এবং সম্ভব হলে স্ট্র ব্যবহার করে লেবুপানি পান করা ভালো, যাতে দাঁতের সরাসরি সংস্পর্শ এড়ানো যায়।

সবশেষে বলা যায়, খালি পেটে লেবুপানি খাওয়ার কিছু সুবিধা থাকলেও তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো অনুচিত। এটি মূলত একটি সহজ ও সস্তা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হতে পারে, যদি আপনি ভালোভাবে সহ্য করতে পারেন। তবে এটিকে কোনও “ম্যাজিক সল্যুশন” বা বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে দেখা ঠিক নয়। আপনি যদি এটি উপভোগ করেন এবং শরীরের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হয়, তাহলে খাওয়া যেতে পারে। তবে যদি গ্যাস্ট্রিক, অম্বল, দাঁতের সমস্যা বা অন্য কোনো অস্বস্তি হয়, তাহলে লেবুপানির পরিবর্তে কেবল উষ্ণ পানি খাওয়াই বেশি ভালো।

স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকে প্রতিটি অভ্যাসের পেছনে যুক্তিসঙ্গত চিন্তা থাকা জরুরি। অন্যের অভ্যাস বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব দেখে নিজের শরীরের উপর কিছু প্রয়োগ না করে, নিজের প্রয়োজন, অসুবিধা ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বুঝে অভ্যাস গড়া সর্বোত্তম। সুতরাং খালি পেটে লেবুপানি খাওয়া উপকারী হতে পারে, তবে তা সবাইকে সমানভাবে উপকার দেবে— এই ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসকের পরামর্শই হওয়া উচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা।

এম.কে.

×