
ছবি: প্রতীকী
প্রতিদিনের শুরুটা যেমন হয়, সারাটা দিন তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। ছোট ছোট অভ্যাসগুলো আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে, যদিও আমরা তা অনেক সময়ই উপলব্ধি করি না। এর মধ্যে একটি অত্যন্ত সাধারণ অথচ উপকারী অভ্যাস হলো সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছানো। এটি শুধু ঘর পরিপাটি রাখার ব্যাপার নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবনের সামগ্রিক গঠনেও এর গভীর প্রভাব রয়েছে।
সকালে বিছানা গুছানো একটি ছোট কাজ হলেও, এটি মনকে এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার বার্তা দেয়। আমরা যখন ঘুম থেকে উঠেই এমন একটি কাজ করি যার পরিণামে তাত্ক্ষণিকভাবে একটি "সম্পূর্ণতা" বা "সফলতা" অনুভব করি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ করে। ডোপামিন হচ্ছে সেই ‘সুখ হরমোন’, যা আমাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোভাব উন্নত করে। এই ছোট্ট কাজটি আমাদের মনকে বুঝিয়ে দেয় যে আমরা দিনের শুরুতেই নিজের উপর একটি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, যা পরবর্তী কাজগুলো সম্পাদনের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও শক্তি জোগায়।
মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য একটা গঠনমূলক রুটিন থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদির সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করেন। এই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে হলে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের অনুশীলন অপরিহার্য। সকালে বিছানা গুছানো হতে পারে সেই অনুশীলনের এক নির্ভরযোগ্য সূচনা। এটি মানসিকভাবে বোঝায় যে দিনটি শুরু হয়েছে, আর আপনি সেটির নিয়ন্ত্রণে আছেন। একধরনের উদ্দেশ্যবোধ ও দায়িত্ববোধের জন্ম হয় যা অলসতা বা অনির্দেশ্য জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বিছানা গুছানোর আরও একটি মানসিক দিক হলো, এটি আমাদের মনের অগোচরে ‘পরিচ্ছন্নতার বার্তা’ দেয়। পরিচ্ছন্নতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও এটি স্বস্তিদায়ক। একটি গুছানো বিছানা দেখলে যেমন চোখে ভাল লাগে, তেমনি মনেও এক ধরণের স্বস্তি ও শৃঙ্খলার অনুভূতি আসে। এই অনুভূতি মানসিক চাপ বা অস্থিরতার বিরুদ্ধে কাজ করে। অগোছালো পরিবেশে মন অস্থির থাকে, অকারণে হতাশা, বিরক্তি বা অবসাদের অনুভব বাড়ে। কিন্তু গুছানো ঘর ও বিছানা আমাদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। ফলে আমরা দিনের অন্যান্য কাজগুলো আরও মনোযোগ ও ধৈর্যের সঙ্গে করতে পারি।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সামরিক ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিছানা গুছানোকে একটি অত্যাবশ্যক রুটিন হিসেবে শেখানো হয়। যেমন আমেরিকান নেভি অ্যাডমিরাল উইলিয়াম ম্যাকক্র্যাভেন তার বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেন, "If you want to change the world, start off by making your bed." তার মতে, বিছানা গুছানো ছোট একটি কাজ হলেও, এটি আপনাকে বড় বড় লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এটি আপনাকে শিখায় ধারাবাহিকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং কৃতজ্ঞতা— এই তিনটি গুণ, যা একটি সুস্থ মানসিকতার ভিত্তি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আত্মসম্মানবোধ ও আত্মমর্যাদা। প্রতিদিন সকালে যদি আপনি বিছানা গুছিয়ে রাখেন, আপনি নিজের প্রতি যত্ন নিচ্ছেন, যা একটি ইতিবাচক আত্মচেতনার জন্ম দেয়। আপনি মনে করেন, “আমি নিজেকে মূল্য দেই, আমি গৃহস্থালির দায়িত্ব নিই।” এই ছোট অনুভূতিই ধীরে ধীরে বড় মানসিক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। বিষণ্নতা বা মানসিক ক্লান্তিতে ভোগা মানুষরা অনেক সময় নিজের জন্য কিছু করতেই অনুৎসাহিত থাকেন। বিছানা গুছানো এমন একটি আত্মকেন্দ্রিক চর্চা, যা সেই অচেতন অবসাদ ভেঙে দিতে সাহায্য করতে পারে।
এছাড়া, রাতে যখন আপনি ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরেন, একটি পরিপাটি বিছানা আপনার মানসিক প্রশান্তি আনে। একটি গুছানো বিছানায় ঘুমানো মানে, আপনি নিজেকে সম্মান করছেন, আপনাকে একটা নিরাপদ ও স্নিগ্ধ আশ্রয় দিচ্ছেন। আর এই ছোট আত্মস্মরণ বা আত্মভালবাসা থেকেই জন্ম নেয় দীর্ঘস্থায়ী মানসিক শান্তি।
মানসিক স্বাস্থ্য একদিনে ভালো হয় না। এটি ছোট ছোট ভালো অভ্যাসের সমষ্টি, যা ধীরে ধীরে আপনাকে গড়তে সাহায্য করে। বিছানা গুছানো হয়তো শুনতে তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই হতে পারে আপনার দিনটি ভালোভাবে শুরু করার প্রথম ধাপ। প্রতিদিন যদি আপনি ঘুম থেকে উঠে নিজের জায়গাটি সুন্দর করে গুছিয়ে রাখেন, আপনি নিজের ভিতরে একটি শক্তি অনুভব করবেন, যা আপনাকে সারাদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
সবশেষে বলা যায়, বিছানা গুছানো মানে শুধু চাদর ঠিক করা নয়; এটি এক ধরণের মানসিক প্রস্তুতি, নিজের প্রতি একটি প্রতিশ্রুতি যে আপনি নিজের যত্ন নেন, আপনি শৃঙ্খলাপূর্ণ, এবং আপনি পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। এই ছোট্ট অভ্যাসটিই একসময় বড় পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে। তাই আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে নিজেই বিছানা গুছিয়ে দিনটি শুরু করুন। দেখবেন, আপনার মানসিক দৃঢ়তা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি কতটা পরিবর্তিত হয়।
এম.কে.