ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

সকালের শুরুটা মোবাইল ছাড়াই করুন— কেন ও কীভাবে?

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৫ জুলাই ২০২৫

সকালের শুরুটা মোবাইল ছাড়াই করুন— কেন ও কীভাবে?

ছ‌বি: প্রতীকী

সকালের সময়টা পুরো দিনের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই সময়ের অভ্যাস ও মুডই ঠিক করে দেয় বাকি সময়টা আপনি কেমন কাটাবেন। কিন্তু আজকের প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে বেশিরভাগ মানুষ ঘুম ভাঙার পরই প্রথমে হাত বাড়ান মোবাইল ফোনের দিকে। কেউ ফেসবুক স্ক্রল করেন, কেউ নিউজ দেখেন, কেউবা ইনবক্স বা ইমেইল চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ এই মোবাইল-নির্ভরতা আমাদের মানসিক প্রশান্তি, মনোযোগ এবং শারীরিক সুস্থতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তাই সকালের শুরুটা মোবাইল ছাড়া করার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এই অভ্যাস শুধু আমাদের স্বাস্থ্য ও মন-মেজাজ উন্নত করে না, বরং আমাদের সময় ব্যবস্থাপনাকেও করে আরও কার্যকর।

সকালে ঘুম ভাঙার পর সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ব্যবহার করলে আমাদের মস্তিষ্ক একপ্রকার "রিয়্যাকটিভ মুডে" প্রবেশ করে। অর্থাৎ, আপনি নিজের দিন শুরু করছেন অন্যের দেওয়া তথ্য, মেসেজ বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেখে, যার বেশিরভাগই আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। এতে করে আপনার মন সেই মুহূর্তেই এক ধরনের অস্থিরতায় ঢুকে পড়ে। দিনের শুরুতেই যদি আপনি বিভিন্ন মানুষের মতামত, নেতিবাচক খবর বা কাজের চাপের বার্তা পান, তাহলে তা আপনার মানসিক অবস্থা খারাপ করে দিতে পারে এবং সারাদিনই এক ধরনের উদ্বেগে কাটাতে হয়।

মোবাইল ছাড়াই সকালের শুরু করলে আপনি প্রথমেই নিজের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলার পর এক-দু’মিনিট নিঃশব্দে শুয়ে থাকা, ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া কিংবা ছোট্ট একটি প্রার্থনা বা কৃতজ্ঞতার ভাবনা নিয়ে দিন শুরু করা মনকে স্থির করে তোলে। এরপর আপনি চাইলে হালকা স্ট্রেচিং, পানি খাওয়া, প্রাতঃভ্রমণ, ধ্যান বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। এসব অভ্যাস শুধু শরীরকে চনমনে করে না, বরং মনকেও করে প্রশান্ত ও সক্রিয়।

প্রত্যেক সকালের কিছু সময় যদি নিজেকে দেওয়া যায়, তাহলে তা ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আপনি আর বাইরের দুনিয়ার প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে বাঁচছেন না, বরং নিজে নিজের দিনটি গড়তে পারছেন সচেতনভাবে।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে এই অভ্যাস শুরু করবেন? যেহেতু বহু মানুষই দিনের শুরু থেকেই মোবাইলে নির্ভর, তাই এই অভ্যাস ত্যাগ করা সহজ নয়। প্রথমত, মোবাইল ঘুমানোর সময় নিজের বিছানার পাশে না রেখে কিছুটা দূরে রাখুন, যেমন অন্য রুমে চার্জে দিয়ে আসা যায়। এতে করে সকালে ঘুম ভাঙার পর স্বাভাবিকভাবেই মোবাইল হাতে নেওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

দ্বিতীয়ত, অ্যালার্ম দেওয়ার জন্য যদি মোবাইলই ব্যবহার করতে হয়, তাহলে শুধুমাত্র অ্যালার্ম বন্ধ করে ফোনটা আবার রেখে দিন। চাইলেই এখন বাজারে ছোট ছোট অ্যালার্ম ক্লক পাওয়া যায়, যা কিনে নিতে পারেন আলাদাভাবে।

তৃতীয়ত, সকালের একটি রুটিন তৈরি করুন, যেখানে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম ৩০ থেকে ৬০ মিনিট কী করবেন, তা আগেই নির্ধারণ করে রাখুন। উদাহরণস্বরূপ: ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ১ গ্লাস পানি পান করবেন, এরপর হালকা স্ট্রেচিং করবেন ৫ মিনিট, তারপর ১০ মিনিট ধ্যান বা মনোযোগের অনুশীলন, তারপর ১৫ মিনিট হাঁটবেন অথবা বই পড়বেন।

চতুর্থত, সকালে মোবাইল ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত লিখে রাখুন কোথাও। দেয়ালে, ডায়েরিতে বা মোবাইল স্ক্রিনের ওয়ালপেপার হিসেবেও রাখতে পারেন “Morning = No Phone” এইরকম একটি বার্তা। মস্তিষ্ক যখন বারবার এই বার্তাটি দেখে, তখন সেটি ধীরে ধীরে একটি মাইন্ডফুল রিমাইন্ডারে পরিণত হয়।

পঞ্চমত, সকালের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (যেমন ৮টা পর্যন্ত) মোবাইল বন্ধ রাখা বা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোডে রাখার চেষ্টা করুন। এই সময়টায় আপনি কাজের মেইল, সামাজিক মিডিয়া বা অন্যান্য অ্যাপে ঢোকার কথা ভাববেনই না।

ধীরে ধীরে যদি আপনি এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই এর সুফল টের পাবেন। মন থাকবে শান্ত, সময় ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে মনোযোগ দিতে পারবেন অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন, যেটা মোবাইল নির্ভর জীবনে প্রায় হারিয়ে যায়।

মোবাইল ফোন নিঃসন্দেহে আধুনিক জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ, কিন্তু তার ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সেটি আমাদের মানসিক শান্তি ও উৎপাদনশীলতার বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই সকালের শুরুটা হোক মোবাইল ছাড়া। নিজের জন্য, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য, নিজের জীবনের গতি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য।

একবার চেষ্টা করে দেখুন। হয়তো প্রথম কয়েকদিন খুব অস্বস্তি হবে, মনে হবে অনেক কিছু মিস করছেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই আপনি বুঝবেন, আসলে আপনি কিছুই মিস করছেন না, বরং আপনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নতুন করে ফিরে পাচ্ছেন। সকালের সেই নিরবচ্ছিন্ন সময়টুকু হয়ে উঠবে আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সময়।

এম.কে.

×