
ছবি: প্রতীকী
সকালের নাশতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেকেই সকালে তাড়াহুড়ো করে নাশতা বাদ দেন কিংবা এমন কিছু খেয়ে নেন যা শরীরের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ দিনের শুরুটা কেমন হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে কী খাওয়া হলো ব্রেকফাস্টে। প্রশ্নটা তাই খুব স্বাভাবিক— সকালে কী খাওয়া উচিত?
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন না ফ্যাট— কোন উপাদানকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ? এ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান, পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের মাঝে নানা ধরনের মতভেদ রয়েছে। তবে আধুনিক গবেষণাগুলো এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এককভাবে কোনো একটি উপাদান নয়, বরং একটি সুষম সমন্বয়ই পারে একটি কার্যকর এবং স্বাস্থ্যকর সকালের নাশতার ভিত্তি তৈরি করতে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীর ও মস্তিষ্কের শক্তি থাকে কম। রাত্রিকালীন উপবাস শেষে আমাদের দেহে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য শরীর চায় সহজে হজমযোগ্য শক্তির উৎস। কার্বোহাইড্রেট হচ্ছে এমন এক ধরনের উপাদান, যা খুব দ্রুত রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে দেয় এবং তাত্ক্ষণিকভাবে শক্তি জোগায়। তাই অনেকে মনে করেন, ব্রেকফাস্টে কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত, যাতে দেহ এবং মস্তিষ্ক কাজ করার জন্য দ্রুত জ্বালানি পায়। উদাহরণ হিসেবে ওটস, লাল আটার রুটি, সেদ্ধ আলু বা ফলমূলকে বিবেচনা করা যায়। তবে এই কার্বোহাইড্রেট হতে হবে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সবিশিষ্ট এবং কম প্রক্রিয়াজাত। তা না হলে রক্তে চিনির মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গিয়ে আবার হঠাৎ নেমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, যার ফলে ঘুম ঘুম ভাব, মনোযোগে ঘাটতি এবং ক্ষুধা বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।
তবে শুধু কার্বোহাইড্রেটেই নয়, প্রোটিনও সকালের খাবারে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন শরীর গঠনের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান। এটি শুধু পেশী গঠনেই ভূমিকা রাখে না, বরং হরমোন নিঃসরণ, রোগ প্রতিরোধ এবং কোষের ক্ষতি মেরামতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সকালের নাশতায় যদি পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকে, তাহলে তা আপনাকে দীর্ঘ সময় পেট ভরা অনুভূতি দিতে পারে। প্রোটিন ধীরে হজম হয়, ফলে বারবার ক্ষুধা লাগে না এবং সারাদিনের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও স্বাভাবিক থাকে। ডিম, দুধ, ছানা, ডাল, বাদাম, সয়াবিন, মাছ বা মুরগির মাংস ব্রেকফাস্টে প্রোটিনের ভালো উৎস হতে পারে। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান কিংবা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন, তাদের জন্য প্রোটিন-সমৃদ্ধ ব্রেকফাস্ট অত্যন্ত উপকারী।
অন্যদিকে, ফ্যাট নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ফ্যাট মানেই খারাপ, যা শরীরের ওজন বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভালো চর্বি শরীরের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। ফ্যাট স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যক্রম, হরমোন উৎপাদন এবং ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে শোষণের জন্য অপরিহার্য। তবে অবশ্যই তা হতে হবে 'স্বাস্থ্যকর চর্বি'— যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, মনো এবং পলিইনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। বাদাম, অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল, ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড এবং ছোট পরিমাণে ঘি বা নারকেল তেল হতে পারে সকালের খাবারে উপকারী ফ্যাটের উৎস। এসব উপাদান হৃদয় সুস্থ রাখে, মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
তবে বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। শুধু এই তিনটি ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট (কার্ব, প্রোটিন, ফ্যাট) নয়, ব্রেকফাস্টে থাকা উচিত ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেলও। ফাইবার হজমে সাহায্য করে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ফলে ব্রেকফাস্টে ফলমূল, শাকসবজি বা দানাশস্য রাখলে তা আরও কার্যকর হয়।
একটি আদর্শ ব্রেকফাস্ট কেমন হতে পারে? ধরুন, দুইটি ডিমের ওমলেট, সঙ্গে কিছু সবজি (যেমন পালং শাক বা টমেটো), এক বাটি ওটস দুধ বা দই দিয়ে, সঙ্গে কিছু বাদাম আর একটি মাঝারি আকারের ফল। আবার কেউ চাইলে লাল আটার রুটি, ছোলার ডাল আর একটি কলাও খেতে পারেন। যারা মিষ্টি পছন্দ করেন, তারা হানি বা খেজুর সিরাপ দিয়ে বানানো ওটমিল খেতে পারেন যাতে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ চিয়া সিড বা ফ্ল্যাক্সসিড যোগ করা হয়। এই ধরনের খাবার একটি ব্যালেন্সড ব্রেকফাস্ট হিসেবে কাজ করবে, যাতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার ও ভিটামিন সবই থাকবে।
অবশ্য একজন ব্যক্তির বয়স, ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী ব্রেকফাস্টের উপাদান ভিন্ন হতে পারে। একজন ক্রীড়াবিদের জন্য হয়তো বেশি কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন, আবার ডায়াবেটিক রোগীর জন্য কম কার্ব, বেশি প্রোটিন প্রয়োজন হতে পারে। তাই একেকজনের জন্য আদর্শ ব্রেকফাস্টের গঠন ভিন্ন হলেও মূল নীতি একই— ভারসাম্যপূর্ণ খাবার গ্রহণ করা, যা শরীরকে সকালের জন্য প্রস্তুত করে এবং সারাদিনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
সবশেষে বলা যায়, ব্রেকফাস্টে কেবল একটি উপাদান নয়, বরং তিনটি মূল পুষ্টি উপাদান কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট সবই থাকা উচিত সঠিক অনুপাতে। এর সঙ্গে থাকা উচিত ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও হাইড্রেশন। ভুলে গেলে চলবে না, সকালটা শুধু শরীরের জন্যই নয়, মন ও আবেগের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর একটি স্বাস্থ্যকর সকালের শুরু মানেই ভালো দিনের সম্ভাবনা। তাই সকালে নাশতার সময় একটু সচেতন হোন। আপনার প্লেটে থাকুক স্বাস্থ্য, স্বাদ এবং ভারসাম্যের ছোঁয়া।
এম.কে.