
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি এখন মানবজাতির সামনে যেমন অসীম সম্ভাবনা নিয়ে আসছে, তেমনি এর দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে দেখা দিয়েছে এক গভীর নিরাপত্তা ও নৈতিক বিতর্ক। বিশ্বজুড়ে সরকার, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, এআই-এর উদ্ভাবনের গতিকে কি লাগামহীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত, নাকি মানবজাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কঠোর নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি?
এআই এখন শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বিষয় নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবার রোগ নির্ণয়, আর্থিক লেনদেনের পূর্বাভাস, এমনকি সৃজনশীল শিল্পেও এআই তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির ক্ষমতা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ।
বিতর্কের মূল কারণসমূহ
ডেটা গোপনীয়তা ও নজরদারি:
এআই সিস্টেম বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। এই ডেটা কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে এবং এর অপব্যবহার (যেমন নজরদারি বা ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস) রোধ করা যাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
ডিপফেক ও বিভ্রান্তি:
'ডিপফেক' প্রযুক্তির মাধ্যমে ফেক ইমেজ বা ভিডিও তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল, গুজব ছড়ানো বা চরিত্র হননের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এআই-এর অপব্যবহারের বড় উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝুঁকি:
সামরিক খাতে এআই-এর ব্যবহার, বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় প্রাণঘাতী অস্ত্রের (Lethal Autonomous Weapons - LAWs) বিকাশ, মানবজাতির জন্য এক বড় নৈতিক সংকট তৈরি করেছে। এমন অস্ত্র যদি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তার ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্ব:
এআই অ্যালগরিদম যদি ভুল ডেটা বা পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যকে (যেমন বর্ণ, লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক বৈষম্য) আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
কর্মসংস্থান হারানোর ভয়:
এআই-চালিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অনেক মানুষের কাজ কেড়ে নিতে পারে, যা বৈশ্বিক বেকারত্ব বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা
এসব উদ্বেগ থেকেই এআই নিয়ন্ত্রণের দাবি জোরালো হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে 'এআই অ্যাক্ট' (AI Act) নামে একটি যুগান্তকারী আইন প্রণয়নের পথে হাঁটছে, যা এআই-এর ঝুঁকি-ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস করে বিভিন্ন স্তরের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনও তাদের নিজস্ব নীতি ও গবেষণা নিয়ে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই-এর দ্রুত উদ্ভাবনকে থামানো সম্ভব নয়, তবে এর বিকাশ যেন মানবকল্যাণমুখী হয় এবং এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলা করা যায়, তার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং কঠোর নীতিমালার প্রয়োজন। এআই-এর নৈতিক ব্যবহারের জন্য একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
এআই মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, তবে তা নির্ভর করবে আমরা কীভাবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করি এবং এর বিকাশে নৈতিকতা ও সুরক্ষার মানদণ্ড বজায় রাখি তার উপর। এই বিতর্কই প্রমাণ করে যে আমরা প্রযুক্তির এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে উদ্ভাবনের পাশাপাশি মানবতাকে রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মিমিয়া