
ছবি: প্রতীকী
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজের সময় হোক কিংবা অবসরে, আমরা স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট বা টেলিভিশনের মাধ্যমে একটানা স্ক্রিনের সঙ্গে জড়িত। একদিকে প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তুলেছে, অপরদিকে এর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে নীরবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই ক্ষয় রোধে ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ বা প্রযুক্তি থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল প্রযুক্তিনির্ভরতা হ্রাস করে না, বরং মানসিক প্রশান্তি, সৃজনশীলতা ও সম্পর্ক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তির অতিনির্ভরতা আজকাল একপ্রকার মানসিক আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে। মানুষ সময় পেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে পড়ে, নিরন্তর স্ক্রল করতে থাকে খবর কিংবা ভিডিওর ফিড। এই লাগাতার তথ্য গ্রহণ আমাদের মস্তিষ্কে অতিরিক্ত উত্তেজনার সৃষ্টি করে, যার ফলে মনোযোগের ঘাটতি, উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন ব্যবহারকারীদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশার ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি। আমরা যত বেশি ডিজিটাল জগতে ডুবে থাকি, বাস্তব জীবন থেকে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
তাছাড়া, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘুমের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিছানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্মার্টফোন ব্যবহারে আমাদের শরীরে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর ফলে ঘুমের গুণগত মান হ্রাস পায়, ঘুমের সময় কমে যায় এবং পরদিন ক্লান্তি ও মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্রনিক ইনসমনিয়ার মতো সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
ডিজিটাল ডিটক্স মানে এই নয় যে প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। বরং এর অর্থ, সচেতনভাবে কিছু নির্দিষ্ট সময় প্রযুক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখা, যাতে মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায় এবং মন নিজেকে পুনরায় সংগঠিত করতে পারে। এই বিরতির সময়টা হতে পারে প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু ঘণ্টা, কিংবা সপ্তাহে একদিন সম্পূর্ণ অফলাইন থেকে কাটানো। এই সময়টাতে প্রকৃতির কাছে যাওয়া, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া বা ধ্যান করা মস্তিষ্কে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে এবং এক ধরনের মানসিক ভারমুক্তি তৈরি করে।
এছাড়া, প্রযুক্তি বিরতির মাধ্যমে ব্যক্তি তার আসল জীবনের অগ্রাধিকারগুলো নতুন করে অনুধাবন করতে পারে। যারা নিয়মিত ‘ডিটক্স’ চর্চা করেন, তাদের মধ্যে আত্মজ্ঞান, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা উন্নত হয়। এমনকি কর্মজীবনের উৎপাদনক্ষমতা বাড়ে, কারণ প্রযুক্তি বিরতির পর মন আরও সতেজ ও কেন্দ্রীভূত থাকে। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এখন উদ্বেগ বা মনোযোগের ঘাটতির চিকিৎসায় ডিজিটাল ডিটক্সের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
প্রযুক্তি বিরতির আরেকটি বড় দিক হলো সম্পর্কের উন্নয়ন। আমরা প্রায়ই কাছের মানুষদের সঙ্গেও প্রযুক্তির কারণে দূরত্ব অনুভব করি। পরিবারে একত্রে বসেও প্রত্যেকে আলাদা স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকে। এটি সামাজিক সংযোগের জায়গায় একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। অথচ প্রযুক্তিমুক্ত সময় একে অপরকে শোনা, বোঝা এবং সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর সুযোগ এনে দেয়। এই সময়ই পরিবার বা প্রিয়জনের সঙ্গে একটি অর্থবহ সময় কাটানোর উপযুক্ত সুযোগ তৈরি করে।
প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের জীবনে অপরিহার্য, কিন্তু সেটির সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখাটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রযুক্তি আমাদের দাস নয়, বরং একটি সহায়ক হওয়া দরকার। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সময়োপযোগী বিরতির অভ্যাস। প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্যই মাঝে মাঝে তাকে ‘বন্ধ’ করা জরুরি। এবং সেই বিরতির মধ্যেই নিহিত থাকে আমাদের মানসিক সুস্থতা, আত্মিক প্রশান্তি এবং জীবনের ভারসাম্য রক্ষার চাবিকাঠি।
এম.কে.