ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

পর্যাপ্ত ঘুম সুস্থ জীবনযাপনের মৌলিক ভিত্তি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ জুলাই ২০২৫

পর্যাপ্ত ঘুম সুস্থ জীবনযাপনের মৌলিক ভিত্তি

ছ‌বি: প্রতীকী

ঘুম মানুষের জীবনের এমন একটি মৌলিক চাহিদা, যা প্রতিনিয়ত আমাদের শরীর ও মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি শুধুমাত্র বিশ্রামের মাধ্যম নয়, বরং এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া।

আমরা প্রতিদিন যা কিছু করি— চিন্তা করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, কাজ করা কিংবা সম্পর্ক রক্ষা করা— এসবের কার্যকারিতা অনেকাংশেই নির্ভর করে আমাদের ঘুম কতটা ভালো হয়েছে তার উপর। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক জীবনে ঘুমকে আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি।

দিনের ক্লান্তি দূর করে শরীরকে পুনরায় কর্মক্ষম করে তুলতে ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক দিনে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে, অপ্রয়োজনীয় তথ্য সরিয়ে দেয় এবং প্রয়োজনীয় স্মৃতিকে সংগঠিত করে। একই সময়ে শরীরের কোষগুলো নিজেকে মেরামত করে, হরমোন নিঃসরণ ঘটে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনর্গঠিত হয়। এই জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো নির্বিঘ্নে চলার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়জুড়ে গভীর ঘুম অপরিহার্য।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। তবে শুধু সময় নয়, ঘুমের মানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই দীর্ঘ সময় বিছানায় কাটান, কিন্তু গভীর ঘুমে যেতে পারেন না। ফলে শরীর আর মন পুরোপুরি বিশ্রাম পায় না। এটি ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শারীরিক ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ, মনোযোগের ঘাটতি, এবং কর্মক্ষমতার হ্রাস ঘটায়। দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের অভাব হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং এমনকি আলঝেইমারসের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ঘুমের মান খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আমাদের অনিয়মিত জীবনযাপন এবং প্রযুক্তিনির্ভর অভ্যাস। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহারের মাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাতজাগার প্রবণতা। অধিকাংশ মানুষ ঘুমানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্ক্রিনে ডুবে থাকে, যা ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন মেলাটোনিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ ব্যাহত করে। ফলে সহজে ঘুম আসে না, ঘুম এলেও তা হয় টুকরো টুকরো এবং অগভীর। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই অভ্যাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।

এছাড়াও, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, এবং জটিল জীবনব্যবস্থাও ঘুমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় ঘুমের সমস্যা থেকে জন্ম নেয় দুশ্চিন্তা, আবার দুশ্চিন্তা থেকেও ঘুম নষ্ট হয়—এই চক্র থেকে মুক্তি না পেলে তা ধীরে ধীরে মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে। তাই ঘুম শুধুমাত্র শারীরিক বিশ্রাম নয়, এটি মানসিক সুস্থতারও ভিত্তি।

এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের সচেতন হতে হবে ঘুমের প্রতি মনোযোগী হয়ে। সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া, ঘুমের আগে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা, হালকা খাবার খাওয়া এবং মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা ঘুমের মান বাড়াতে সাহায্য করে। আমরা যতটা গুরুত্ব দেই খাদ্য, ব্যায়াম বা ওষুধে, ততটাই গুরুত্ব ঘুমের ওপরও দেওয়া উচিত। ঘুমকে যদি আমরা জীবনের মূলধন হিসেবে গ্রহণ করি, তবে এর বিনিয়োগ থেকেই মিলবে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতা।

অতএব, ঘুমকে আর অবহেলা নয়, বরং জীবনচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে আনা উচিত। সুস্থতা, সৃজনশীলতা ও স্থিতিশীল মানসিক অবস্থার জন্য এটি এক অনস্বীকার্য শর্ত। নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে এখনই সময় নিজ জীবনে একটি স্বাস্থ্যকর ঘুমচক্র গড়ে তোলার। কারণ, ঘুম ঠিক থাকলে জীবনও ঠিক থাকে।

এম.কে.

×