
ছবি: জনকণ্ঠ
- পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতা আর সম্মিলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাই পারে রক্ষা করতে।
এক সময় চামড়ার রোগকে গরিবের রোগ বলা হতো। অথচ আজ শহর থেকে গ্রাম, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে বিশেষ করে কুমিল্লা, পাবনা, পটুয়াখালী, বরগুনা, রাজশাহীতে বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় অবহেলা।
স্ক্যাবিস কোনো প্রাণঘাতী রোগ নয়, কিন্তু অবহেলায় এটি গোটা পরিবার, এমনকি স্কুল, হোস্টেল বা বাসাবাড়ি জুড়ে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা যখন এই রোগটিকে ‘সাধারণ’ মনে করে চিকিৎসা না নেই, তখনই এটি ভয়ঙ্কর রূপ নেয়।
স্ক্যাবিসের জীবাণু, Sarcoptes scabiei নামক মাইট, ত্বকের নিচে ডিম পাড়ে এবং তীব্র চুলকানি ও গুটির সৃষ্টি করে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সরাসরি স্পর্শ, কিংবা কাপড়, তোয়ালে, বিছানার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে।
আমাদের সমাজে এ ধরনের রোগ নিয়ে লজ্জা, গোপনতা ও অবহেলা বিদ্যমান। অনেকে ডাক্তার দেখায় না, নিজের মতো ওষুধ লাগায়, কিংবা সমস্যাটা চেপে রাখে। ফলে আরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।
এই জীবাণুটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে—
- ঘনিষ্ঠ শরীরের সংস্পর্শে
- আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, চাদর, তোয়ালে, বালিশ ব্যবহারে
- দীর্ঘসময় একই বিছানায় অবস্থানে
- স্কুল, হোস্টেল, মাদ্রাসা বা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে দ্রুত ছড়ায়
লক্ষণ যেগুলো অবহেলা করলে বিপদ বাড়ে
- স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণ হলো—
- রাতের বেলায় তীব্র চুলকানি
- আঙুলের ফাঁকে, কবজি, কনুই, স্তনের নিচে ও কোমরের গিটে লালচে ফুসকুড়ি
- চামড়ার নিচে সরু সাদা বা ধূসর দাগ
- শিশুদের মুখমণ্ডল, মাথা ও পায়ের পাতা পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে
- চুলকানোর ফলে ত্বকে ঘা, ফোসকা বা ইনফেকশন দেখা দেয়
অনেকেই এই লক্ষণগুলো দেখে সাধারণ চুলকানি বা এলার্জি ভেবে থাকেন এবং ভুল চিকিৎসা করেন। এতে রোগ সারার বদলে আরও ছড়ায়। স্ক্যাবিস শতভাগ নিরাময়যোগ্য, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন।
বিশেষ সতর্কতা:
- শুধু রোগী নয়, একই বাড়ির সব সদস্যকে চিকিৎসা নিতে হবে
- ব্যবহার করা সব কাপড়, তোয়ালে, চাদর, বালিশের কাভার গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে
- যেসব কাপড় ধোয়া সম্ভব নয়, সেগুলো ৪-৫ দিন পলিথিনে আটকে রাখা জরুরি
ডা. জান্নাতুন নাছেরা জুঁই নামের একজন চিকিৎসক বলেন, “স্ক্যাবিস দেখা দিলে মানুষ অনেক সময় আত্মগোপনে চলে যায়। তারা ভাবে এটা সাধারণ চুলকানি। কিন্তু এই রোগ একবার একজনের মধ্যে থাকলে, তা ঘরের অন্য সদস্যদের মধ্যেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই একসঙ্গে চিকিৎসা না নিলে কেউই পুরোপুরি সেরে উঠবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রায়শই দেখি, স্কুলে এক ছাত্র স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে কিছুদিনের মধ্যে পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে পড়ে। তাই স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো এখন অত্যন্ত জরুরি।”
আমরা কী করতে পারি?
প্রতিরোধই প্রধান অস্ত্র
১. পরিবারভিত্তিক প্রতিরোধ: পরিবারের কেউ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে বাকি সদস্যদেরও একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে। শুধু রোগীকে ওষুধ দিলে স্ক্যাবিস পুরোপুরি নির্মূল হবে না।
২. স্কুল, কলেজ ও হোস্টেলে সচেতনতা: শিশুদের মধ্যে স্ক্যাবিস বেশি দেখা যায়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও হোস্টেলগুলোতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, হাইজিন শিক্ষা ও পৃথক বিছানা ব্যবহারের ব্যবস্থা জরুরি।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: জামাকাপড়, চাদর, বালিশের কাভার নিয়মিত ধোয়া, গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আলাদা করে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার।
৪. গণসচেতনতা: স্ক্যাবিস নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে হবে। এটি লজ্জার নয়, প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্ক্যাবিস বিষয়ে প্রচারণা চালাতে পারে।
৫. রোগ লুকিয়ে না রাখা: রোগ দেখা দিলে লুকিয়ে না রেখে দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা নেয়া দরকার।
স্ক্যাবিস প্রতিরোধ করতে হলে ব্যক্তিগত সচেতনতা, পারিবারিক সতর্কতা ও সামাজিক উদ্যোগ একত্রে প্রয়োজন। চিকিৎসা যেমন জরুরি, তেমনি প্রতিরোধও গুরুত্বপূর্ণ। স্ক্যাবিসকে যদি আমরা হালকা চোখে দেখি, তবে তা ভবিষ্যতে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
তাই এখনই সময়, স্ক্যাবিস ঠেকাতে চাই শক্ত প্রতিরোধ।
শহীদ