
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে যখন সংঘাতের দামামা বাজছে, মধ্যপ্রাচ্যে সদ্য সমাপ্ত ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন করে বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। গত ১৩ই জুন ইসরায়েলের হামলার সূচনা এবং ২২শে জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের ওপর হামলা, এরপর ২৪শে জুন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া—এই দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহ বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক জটিল ও অনিশ্চিত মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। এমন এক অস্থির সময়ে, নিজেদের দুর্বল সামরিক সক্ষমতা, প্রকট প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা, এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নিরাপত্তা ও প্রস্তুতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকা কি এই বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত?
বর্তমান সময়ের ইরান ইসরাইল স্বল্পস্থায়ী সংঘাত বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে মেরুকরণের ইঙ্গিত দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর সংঘাতের সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছে। এই উত্তাল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ কি তার অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখতে পারবে? যখন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাষ্ট্রগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রদর্শনে দ্বিধা করছে না, তখন সীমিত সামরিক প্রস্তুতি ও দুর্বল প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত অবস্থানে রয়েছে
বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতার প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলো দীর্ঘকাল ধরেই প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের উদ্বেগের কারণ। প্রতিরক্ষা বাজেটের অপ্রতুলতা এর মূলে নিহিত। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সামরিক ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এতটাই নগণ্য যে তা আধুনিক প্রতিরক্ষা চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। এই সীমিত বরাদ্দ আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ, প্রযুক্তিগত আপগ্রেডেশন এবং পেশাদার সৈন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে, আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে আছে। দেশের সামরিক ভান্ডারে যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেমস (SAMs) সহ বিভিন্ন সমরাস্ত্র থাকলেও, সেগুলো প্রায়শই পুরোনো প্রযুক্তি নির্ভর এবং সংখ্যায় অপ্রতুল। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকতে হলে উন্নত প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, শক্তিশালী নৌ সক্ষমতা এবং সাইবার যুদ্ধ প্রতিরোধের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এই ক্ষেত্রগুলোতে এখনো অনেক পিছিয়ে।
বিশ্বের অনেক দেশ যখন নিজস্ব মেধার মাধ্যমে অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে, তখন বাংলাদেশ এখনও আধুনিক সমরাস্ত্রের জন্য আমদানির উপর চরমভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা সংকটকালে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এবং দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলতে পারে। পার্শ্ববর্তী পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের মতো সামরিক পরাশক্তির পাশে দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশ কি দ্রুত পরিবর্তনশীল হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট সজ্জিত? সামরিক অবকাঠামোগত দুর্বলতাও প্রকট। বিমানবন্দর, নৌঘাঁটি এবং অন্যান্য কৌশলগত সামরিক স্থাপনাগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি। গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগের অভাব দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে মারাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো না গেলে সংকটকালে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এক নজিরবিহীন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়'—এই সরল পররাষ্ট্রনীতি আপাতদৃষ্টিতে শান্তির বার্তা দিলেও, বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন জোর দিয়ে বলেন, "নিরপেক্ষতার নামে আমরা অনেক সময় নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করি, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। যখন আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের কৌশলগত স্বার্থ পূরণে আগ্রাসী হচ্ছে এবং পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় তাদের প্রভাব আরও বাড়ছে, তখন বাংলাদেশের দুর্বল ও প্রতিক্রিয়াশীল পররাষ্ট্রনীতি কি দেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আদৌ সক্ষম?"
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ধারাবাহিক হামলা বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলকে মারাত্মকভাবে অনিরাপদ করে তুলেছে। রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের জেরে গোলাবর্ষণ, বিমান হামলার এবং ব্যাপক মানবিক সংকট বাংলাদেশেকে উদ্বিগ্ন করছে।এই সীমাহীন সীমান্ত অস্থিরতা কি দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির পথে একটি গুরুতর অন্তরায় নয়?
একইসাথে, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর এক বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এই মানবিক সংকটের স্থায়ী কূটনৈতিক সমাধান না হওয়ায় দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে। UNHCR এর মতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আঞ্চলিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
অর্থনৈতিক চাপ সরাসরি সামরিক সক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো, উর্ধ্বগামী মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটকে আরও সীমিত করছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, "একটি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী অর্থনীতি ছাড়া কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা শেষ পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করে।"
গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মব জাস্টিস মতো ঘটনা দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি স্থিতিশীল ও সুসংহত সরকার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন করা কঠিন। এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কি দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির পথে একটি বড় বাধা নয়? অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ দেশের জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা সংকটকালীন সময়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের কিছু অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে, যা তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে উদ্ভূত। এর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ একটি অপরিহার্য ট্রানজিট পয়েন্ট যা তার কৌশলগত অংশ হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘ ১ লক্ষ ২৪ হাজার বর্গমাইলব্যাপী সমুদ্রসীমা 'ব্লু ইকোনমি' বা সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে। বন্দর উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং সমুদ্র বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে পারে। আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্য এবং জ্বালানি নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমুদ্রপথ কি বৈশ্বিক পরাশক্তিদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না?
বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং আঞ্চলিক জটিলতার এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে কিছু কঠোর, বাস্তবসম্মত এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং সৈন্যদের আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুতগতির নৌযান, উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা, আধুনিক যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেমস সহ প্রয়োজনীয় সকল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম গুণগত মান ও সংখ্যায় আপগ্রেড করা অপরিহার্য। প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি, যাতে বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমানো যায় এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
সবশেষ বলতে হয় বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং আঞ্চলিক জটিলতার এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে, দেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ কেবল নিজেদের সার্বভৌমত্বই রক্ষা করবে না, বরং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এখন প্রয়োজন, জাতীয় ঐক্য ও সুদূরপ্রাপ্য পরিকল্পনা, যা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশকে প্রস্তুত করবে এবং নিশ্চিত করবে এর টিকে থাকার লড়াইয়ে সফলতা।
রমজান গাজী
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারুক