ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

দাবাকে জাতীয় শক্তি বানানো দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

শেখ আফনান বিরাহীম

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২ জুলাই ২০২৫

দাবাকে জাতীয় শক্তি বানানো দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

ছবিঃ সংগৃহীত

মাত্র কয়েক দশক আগেও, বাংলাদেশ ও ভারত দাবার বিশ্বে প্রায় একই অবস্থানে ছিল, কাঠামোগতভাবে বেশ দুর্বল। হাতে গোনা কয়েকজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিলেন, কিন্তু তাদের সহায়তা করার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। বর্তমান চিত্রে, ভারত বিশ্বে দাবার ক্ষেত্রে অন্যতম শক্তিধর দেশ। প্রজ্ঞানন্দ, গুকেশ, অর্জুনসহ অসংখ্য কিশোর গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরি করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ১৯৮৭ সালে নিয়াজ মুরশেদের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েও সেই অর্জনের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি।

প্রশ্ন উঠবেই আমাদের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও এখনো এতো পিছিয়ে কেনো? আর অন্য অনেক দেশ যেখানে তৈরি করেছে দাবার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা?

ভারতে দাবার জাগরণ শুরু হয় বিশ্বনাথন আনন্দের হাত ধরে। তার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া পুরো দেশকে উৎসাহিত করে। কিন্তু সেই অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে তারা গড়ে তোলে একটি সার্বিক কাঠামো। অল ইন্ডিয়া চেস ফেডারেশন মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বাড়ায়, বিভিন্ন রাজ্যে দাবাকে শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করা হয়, এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষণ ও টুর্নামেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।

বাংলাদেশে সেই ধারাবাহিকতা তৈরি হয়নি। খেলাটির যতোটুকু চর্চা রয়েছে তা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। কিছু প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট প্রচেষ্টার বাইরে বিস্তৃত পরিকল্পনা বা সমন্বিত উদ্যোগ ছিলো না। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। তবুও এখনও সময় আছে নতুন করে শুরু করার।

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ইতিবাচকতা দেখা যাচ্ছে। তরুণ খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছেন, Lichess ও Chess.com-এর মত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খেলছেন ও শিখছেন। ঢাকা ছাড়াও বেশ কয়েকটি শহরের স্থানীয় ক্লাবগুলো নবীনদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিছু বেসরকারি স্কুলে দাবাকে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে নিয়েছে।

কিন্তু এই উদ্যোগগুলো এখনো বিচ্ছিন্ন ও সীমিত। জাতীয় পরিকল্পনা ও সরকারি সমর্থন ছাড়া এসব প্রচেষ্টা বেশি দূর এগোতে পারবে না।

আর্মেনিয়া থেকে বাংলাদেশ অনুপ্রেরণা নিতে পারে। মাত্র ৩০ লাখ মানুষ, অথচ তারা তিনবার দাবা অলিম্পিয়াড জিতেছে। এর মূল কারণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।

২০১১ সাল থেকে আর্মেনিয়া ছয় বছর বয়স থেকেই স্কুলে দাবা বাধ্যতামূলক করেছে। আর্মেনিয় সরকার শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম তৈরি ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেছে। তারা দাবাকে শুধুমাত্র খেলা নয়, বরং যুক্তিবিদ্যা, মনঃসংযম ও পরিকল্পনামূলক চিন্তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এমনকি শুধু সরকার নয়, অভিভাবক ও শিক্ষকরাও দাবাকে শিশুর মানসিক বিকাশের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও যদি দাবাকে শুধু খেলা হিসেবে না দেখে একটি মানসিক চর্চা ও শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বাড়বে।

আর্মেনিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের আরও কয়েকটি ছোট দেশ দেখিয়ে দিয়েছে, দাবায় সফল হতে হলে অর্থ বা জনসংখ্যা নয় প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুসংগঠিত উদ্যোগ। আইসল্যান্ড যেটি মাত্র চার লাখ মানুষের দেশ, অথচ প্রতি জনসংখ্যায় তাদের গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। আইসল্যান্ডে লাইব্রেরি ও স্কুলে দাবা শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। জর্জিয়া নারীদের দাবায় বিশ্বে নেতৃস্থানীয়, যেখানে নারী খেলোয়াড়দের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আজারবাইজানও রাষ্ট্রীয় সহায়তায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাবা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দেশগুলো দেখিয়েছে ছোট দেশ বড় সাফল্য আনতে পারে, যদি সঠিক কৌশল ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন থাকে।

বাংলাদেশ চাইলেই এসব দেশের মডেল নিজেদের উপযোগী করে গ্রহণ করতে পারে। জনসংখ্যা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রতিভার বিচারে আমাদের সুযোগ আরও বড়। শুধু দরকার সদিচ্ছা ও পরিকল্পিত উদ্যোগ।

দাবা খেলাটিকে যদি কেবল বিনোদন হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এর প্রকৃত শক্তি আমরা উপলব্ধি করতে পারব না। গবেষণায় দেখা গেছে দাবা খেলা শিশুরা গাণিতিক দক্ষতা, স্মৃতিশক্তি, ও সমস্যা সমাধানে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। তারা আরও ধৈর্যশীল ও মনঃসংযত হয়। দাবা আমাদের শুধু জিততে শেখায় না, পরিকল্পনা করতে শেখায়, ধৈর্য ধরতে শেখায়, এবং দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতে শেখায়। এসব গুণ একটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের যে কোনো কর্মক্ষেত্রেই প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে নিয়মিত দাবা খেলার চর্চা হতে পারে একটি নিম্ন খরচের কিন্তু উচ্চ ফলপ্রসূ মাধ্যম। কারন এজন্য জন্য কোনো বড় মাঠ বা জটিল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। স্মার্টফোনে অ্যাপ ডাউনলোড করে খেললেতো কোনো কথাই নেই। ফলে দাবা হতে পারে গ্রামের দরিদ্র স্কুলগুলোতেও শিক্ষার অংশ। 

তবে বাংলাদেশ যদি দাবায় এগিয়ে যেতে চায়, তবে এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন: 

প্রথমত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দাবাকে ঐচ্ছিক বিষয় বা ক্লাব কার্যক্রম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বাংলা ভাষায় সহজ পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের শাখা থাকবে বিভাগীয় শহরগুলোতে। সেগুলোতে প্রতিভাবানদের শনাক্ত করে সঠিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রতিযোগিতাও হবে নিয়মিত। সরকারিভাবে ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়মিত বৃত্তি ও ক্যাম্প চালু করতে হবে।

তৃতীয়ত, ইউটিউব বা মোবাইল অ্যাপে বাংলা ভাষায় দাবার পাঠ, টিপস, লাইভ গেম বিশ্লেষণ তৈরির কন্টেন্ট আরো ভালো করে করতে হবে। অনলাইনে স্কুল টুর্নামেন্ট পরিচালনার জন্য Lichess-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে।

চতুর্থত, পুরোনো খেলোয়াড়দের পাশাপাশি নতুন খেলোয়াড়রা যারা ভালো করছে তাদের জাতীয়ভাবে সম্মান জানানো উচিত। তাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি, সাক্ষাৎকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রোগ্রাম চালু হলে নবীনদের আগ্রহ অনেক বাড়বে।

বাংলাদেশ যদি এখন উদ্যোগ না নেয়, তাহলে আরও একটি প্রজন্ম দাবার ক্ষেত্রতে অনেকটাই পিছিয়ে থাকবে। প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা নিজেদের বিকশিত করা সুযোগের অভাবে নিজেদের গুটিয়ে নিবে। এবং আমরা হারাব সেই সম্ভাবনাকে, যা একদিন দেশকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত।

প্রতিটি দাবার খেলাই শুরু হয় একটি চাল দিয়ে। বাংলাদেশও এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রথম চালের মুখোমুখি। বোর্ড প্রস্তুত, খেলোয়াড়রাও প্রস্তুত। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনি সময়।

লেখকঃ শেখ আফনান বিরাহীম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়।

আলীম

×