ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

‘অরবিস’ উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল: আকাশপথে চোখের চিকিৎসা

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০:১৪, ৩ জুলাই ২০২৫

‘অরবিস’ উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল: আকাশপথে চোখের চিকিৎসা

ছবি: জনকণ্ঠ

দূর থেকে দেখলে এটিকে হয়তো সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু এর ভেতরে ঢুকলেই দেখা যাবে এক অভিনব দৃশ্য—একটি পূর্ণাঙ্গ, অত্যাধুনিক চক্ষু হাসপাতাল। এমডি-১০ মডেলের এই বিমানটিই বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র “উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল”, যা পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অরবিস ইন্টারন্যাশনাল।

১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই ফ্লাইং আই হসপিটাল বিশ্বজুড়ে দৃষ্টি সুরক্ষার লড়াইয়ে এক বৈপ্লবিক উদ্যোগ। অরবিসের এই বিমান হাসপাতাল এখন পর্যন্ত ৯৫টি দেশে গিয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গোলিয়ায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করে এটি আসে বাংলাদেশে এবং এরপর যাবে রোমানিয়ায়।

অরবিসের মূল কাজ চোখের চিকিৎসা ও অন্ধত্ব প্রতিরোধে স্থানীয় চিকিৎসকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা। তারা শুধু রোগীর চিকিৎসাই করে না, স্থানীয় চক্ষু চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানদের হাতে-কলমে শেখায় অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার এবং জটিল অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি।

এমডি-১০ বিমানটি সাধারণত প্রায় ৪০০ যাত্রী বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু অরবিস এটিকে রূপান্তর করেছে সম্পূর্ণ একটি উড়ন্ত হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এর ভেতরে রয়েছে চারটি প্রধান কক্ষ—যেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার,হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, অক্সিজেন স্যাচুরেশন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা,চোখের রেটিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (ICU)। এক কক্ষ সাজানো হয়েছে ৫০ জনের ক্লাসরুম হিসেবে, যেখানে সরাসরি বা অনলাইন ক্লাস হয় দেশের নানা প্রান্তের চিকিৎসকদের জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিমানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির অনেকগুলোই বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে নেই। কিছু সরকারি হাসপাতালে থাকলেও সেগুলো ব্যবহারে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অনেক চিকিৎসকের নেই। এই বিমান প্রশিক্ষণ সেই ঘাটতি পূরণে সহায়ক।

অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশের চক্ষু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তারা ১১ বার এই বিশেষ উড়ন্ত হাসপাতালটি বাংলাদেশে এনেছে।

অরবিসের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত তারা প্রায় ১,৮০০ বাংলাদেশি চক্ষু পেশাজীবীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরের সর্বশেষ সফরে বিমানটি ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে দুই সপ্তাহের জন্য।

অরবিস কেবল এই দুই সপ্তাহের সরাসরি প্রশিক্ষণেই থেমে যায় না। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা পরবর্তীতে ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণেও যুক্ত থাকবেন এবং স্থানীয় হাসপাতালভিত্তিক আরও দুই ধাপের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পাবেন।

প্রশিক্ষণার্থীরা বলেন—“বইয়ে পড়া জিনিসগুলা এখানে হাতে-কলমে শিখছি। এই অভিজ্ঞতা দেশে গিয়ে রোগী ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।

আরেকজন বলেন—“অনলাইন কোর্সে পরীক্ষায় পাস করে এখানে আসছি। সরাসরি শিখে হাসপাতালে ব্যবহার করা সহজ হবে।”

অরবিস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও সিইও ডেরেক হডকি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন—“আমাদের লক্ষ্য শক্তিশালী ও টেকসই চোখের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাংলাদেশে এ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চোখের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করবে।”

বিশ্বের একমাত্র উড়ন্ত চোখের হাসপাতাল অরবিস শুধু প্রযুক্তি নয়, সেবারও দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে এই ফ্লাইং আই হসপিটাল এর আগেও বহুবার এসেছে এবং হাজারের বেশি পেশাজীবীকে প্রশিক্ষিত করেছে। এর ফলেই বাংলাদেশের চক্ষু চিকিৎসা দিনে দিনে আরও আধুনিক ও বিশ্বমানের হয়ে উঠছে।

প্রশিক্ষণার্থীরা বারবার এই বিমান হাসপাতালকে দেশে আনার দাবি তুলেছেন। কারণ আকাশপথে ঘুরে বেড়ানো এই হাসপাতাল শুধু রোগীর চোখের আলো ফিরিয়ে দেয় না—দেয় দৃষ্টি চিকিৎসার নতুন আলো।

আবির

×