
ছবি: জনকণ্ঠ
হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত জনপদ দিরাই-শাল্লা। উর্বরা কাঁদামাটি আর সুবিশাল জলরাশীর মাঝে দ্বীপের ছোট ছোট গ্রাম কিংবা মহল্লা নিয়ে গড়ে ওঠা দিরাই শাল্লার মানুষ নানান বিষয়ে বরাবরই দেশ বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামলে নিয়ে বেড়ে ওঠা অঞ্চলটির মানুষ বরাবরই প্রখর মেধাবী, সাহসী আর নেতৃত্ব গুণাবলি সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুনামগঞ্জ তথা ভাটি অঞ্চলের রাজনীতিতে দিরাই শাল্লার ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নাছির উদ্দীন চৌধুরী, অক্ষয় মিনিস্টার সহ দেশখ্যাত রাজনৈতিকের জন্ম দিয়েছে ভাটির এই জনপদ। যেকারণে দিরাই শাল্লাকে বলা হয় ভাটি এলাকার রাজনীতির তীর্থস্থান। বিভিন্ন দলের বা মতের মানুষ থাকলেও দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার রাজনৈতিক সম্প্রীতি অনেক সমৃদ্ধ। ভিন্ন দলের নেতাকর্মী হলেও একই সাথে চায়ের আড্ডা, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সহাবস্থান এখানকার রাজনৈতিক সম্প্রীতিকে দিন দিন সুদৃঢ় করে তুলছে৷
গত বছরে জুলাইয়ে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের অধিকাংশ জায়গাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ব্যতিক্রম ছিল দিরাই শাল্লা। এখানকার রাজনৈতিক নেতাদের ইতিবাচক মানসিকতায় কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
গেল কিছুদিন আগে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাবেক এমপি, বিএনপি নেতা নাছির উদ্দীন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এসময় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে দেখতে হাসপাতালে এবং তার বাসা উত্তোরায় ছুটে যান বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সাবেক এমপি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী রুমী, জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী এড.শিশির মনির, এনসিপির মনোনয়ন প্রত্যাশী অনিক রায় সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এসময় তাদেরকে প্রাণবন্ত আড্ডা গল্পে সময় কাটাতে দেখা যায়। নিজ দল কিংবা ভিন্ন দল মতের প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থীর প্রতি এমন শ্রদ্ধা ভালবাসা দেশের রাজনৈতিক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত।
এছাড়াও গত ঈদুল আজহার পর লন্ডন সফরে যান এড. শিশির মনির। এসময় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী এড. তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল তার নিজ বাসায় শিশির মনিরকে নিমন্ত্রণ করেন। পরবর্তীতে তাদেরকে প্রাণবন্ত আড্ডায় দেখা যায়। তাদের আনন্দঘন মূহুর্তের কিছু ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রসংশা কুড়োয়।
আগামী বছরের প্রথম দিকে দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে সুনামগঞ্জ -২ (দিরাই -শাল্লা) থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন, নাছির উদ্দীন চৌধুরী, তাহির রায়হান চৌধুরী পাবেল, সাবেক বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী রুমী, আজমল হোসেন চৌধুরী জাবেদসহ আরও বেশকজন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এড.শিশির মনির, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ থেকে মাওলানা শুয়াইব আহমদ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে অনিক রায় নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিছুদিন পরই ভোটের মাঠে একই আসনে তারা লড়বেন। এমন অবস্থায় নেতাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি এমন শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং আন্তরিকতার বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতীতে খুব কমই দেখা যায়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নেতাদের মধ্যে মারামারি, এক দলের সভায় অন্য দলের হামলা ভাঙচুর, খুন-রাহাজানি কিংবা প্রতিহিংসা যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারণ বিষয়। এমন বাস্তবতায় দিরাই শাল্লার এই রাজনৈতিক সম্প্রীতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য উদাহরণ হতে পারে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এমন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রতিহিংসার বদলে সুষ্ঠু প্রতিযোগীতাই বদলে দিতে পারে দেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভিন্ন দল কিংবা মতের প্রতি শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সহাবস্থানের এই সংস্কৃতি দিরাই শাল্লার মতোই ছড়িয়ে যাবে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া। সম্প্রীতির এই গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ুক ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশে। সত্যিকার অর্থেই যেটি হবে দেশের রাজনীতি, দশের রাজনীতি। যেখানে প্রতিহিংসা নয় বরং রাজনীতি হবে সুষ্ঠু প্রতিযোগীতা আর নির্মল সম্প্রীতির।
শিহাব