
ছবি: জনকণ্ঠ
একজন মানুষ কুরআনের রক্ষক। রাষ্ট্রপ্রধান, শান্তিকামী, বিনয়ী, এবং সবার চেয়ে বড় পরিচয়—নবীর জামাতা। তাঁকে হত্যা করা হয় কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায়। রক্তে ভিজে যায় কুরআনের পৃষ্ঠা। ঘাতকরা দাবি করে, তারা ন্যায়ের পক্ষে। অথচ ইতিহাস বলে, তারা ছিল উগ্র, বিভ্রান্ত এবং হিংস্র।
এই লেখা সেই ঘটনা নিয়েই, যা শুধু এক খলিফার শাহাদাত নয়, এক উম্মাহর হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষতের মতো হয়ে আছে।
অধ্যায় ১: “জুন-নুরাইন”—দুই নূরের আলো
উসমান ইবন আফফান (রাঃ) ইসলামের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি রাসূলের দুই কন্যাকে পরপর বিয়ে করেন। রুকাইয়াহ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর উম্মে কুলসুম (রাঃ)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাই তাঁর উপাধি "জুন-নুরাইন" (দুই নূরের অধিকারী)।
উসমান (রাঃ) কুরাইশ বংশের অভিজাত পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, অত্যন্ত লাজুক, পরহেযগার ও দানশীল। ইসলামের জন্য দিতেন উদার হৃদয়ে সবকিছু। যুদ্ধ হোক বা দুর্ভিক্ষ, তাঁর দান ছিল সীমাহীন। মক্কার ধনী ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ করেন সে সময়, যখন এটার মানে ছিল—ব্যক্তিগত ব্যবসা ও সামাজিক অবস্থান হারানো।
অধ্যায় ২: শাসকের সিংহাসন, দানের হাত
খিলাফতের সময় ইসলামি ভূখণ্ড বিস্তার পায় পূর্বে পারস্য থেকে পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত। উসমান (রাঃ) এই সময়টাতে একাধারে প্রশাসক, কুরআনের সংরক্ষক এবং জনসাধারণের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন।
তিনি ব্যক্তিগত খরচে:
মদীনার মসজিদ সম্প্রসারণ করেন
রোমা কূপ কিনে সবার জন্য ওয়াকফ করে দেন
যুদ্ধকালীন সময়ে শত শত উট ও স্বর্ণ দান করেন
অধ্যায় ৩ : কুরআনের সংরক্ষক
উসমান (রাঃ)-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান—কুরআন শরীফকে একটি নির্ভরযোগ্য পাঠে সংরক্ষণ ও বিতরণ।
ইসলামের ভূগোল যখন বিস্তৃত হয়ে পড়ে, তখন নানা পাঠভেদের কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সাহাবীদের পরামর্শে "রস্মে উসমানী" পদ্ধতিতে কুরআনের একটি আদর্শ সংস্করণ তৈরি করান এবং তা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। আজকের দিনে আমরা যে কুরআন পাঠ করি, তা উসমান (রাঃ)-এর সেই কর্মেরই ফল। এটাই আজকের বিশ্বের সকল কুরআনের স্ট্যান্ডার্ড রূপ।
অধ্যায় ৪: মিথ্যাচার, গুজব ও উগ্রতার জমিন
মদীনার শান্ত পরিবেশে তখনো হালকা বাতাস বইছিল। কিন্তু রাজধানীর দেয়ালের বাইরে থেকে এক অদৃশ্য আগুন ঢুকে পড়ছিল—গুজব, অপপ্রচার এবং ধর্মের নামে উগ্রতার আগ্নেয়গিরি। লক্ষ্য একটাই: উসমান ইবন আফফান (রাঃ)। একজন শক্তিশালী ও ন্যায়পরায়ণ খলিফা, যিনি যুদ্ধ নয়, শান্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। একাধিক শহর—মিশর, কুফা, বসরা থেকে আগত একদল দুর্বৃত্ত ও কূটনীতিক ষড়যন্ত্রী সুপরিকল্পিতভাবে মদীনার রাজনীতি ও জনমনে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে গুজব রটায়, “খলিফা আত্মীয়দের প্রাধান্য দিচ্ছেন, বিচার করছেন পক্ষপাতদুষ্টভাবে ও তিনি পূর্ববর্তী খলিফাদের মতো কঠোর নন।” এই অভিযোগ প্রথমে চিঠিতে, পরে জনশ্রুতিতে ছড়ায়। হেঁশেল থেকে হাট, মসজিদ থেকে মজলিস—সর্বত্র ফিসফাস, সন্দেহ আর গুঞ্জনের ঝড়। অথচ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। উসমান (রাঃ) একাধিকবার এই গোষ্ঠীগুলোকে মদিনায় ডেকে এনে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথা ছিল: “তোমাদের অভিযোগ থাকলে প্রমাণ দাও, আমি বিচার চাই। কিন্তু যদি সত্য না জানো, তবে কাউকে ফেতনার দিকে ঠেলে দিও না।”
তবুও অভিযোগকারীরা সরে আসেনি। তারা সত্য চায়নি—তারা প্রতিশোধ চাইত। তারা ন্যায় বিচার নয়—একটি খলিফার পতন চেয়েছিল।
তাহলে এই বিদ্রোহীরা কারা? প্রাথমিকভাবে তারা নিজেদের পরিচয় দেয় 'সত্যবাদী মুসলিম', 'ন্যায়ের দাবি তোলা সাধক'।
কিন্তু নথি-নির্ভর অনুসন্ধানে উঠে আসে, তারা ছিল:
রাজনৈতিক গোপন গোষ্ঠী, যারা একজোট হয়ে বিদ্রোহ সংগঠিত করছিল।
গুজবনির্ভর দাঙ্গাবাজ, যাদের কাছে মসজিদ আর মিথ্যা ছিল হাতিয়ার।
উগ্রবাদী বিশ্বাসে আত্মরুদ্ধ, যারা যুক্তি নয়—আক্রোশে বিশ্বাস করত।
শেষ পর্যন্ত খলিফার ঘাতকদল, যাদের হাতে ইতিহাস কলঙ্কিত হয়।
তাদের সমস্ত তৎপরতা ছিল ধর্মের ব্যানারে, কিন্তু অভিপ্রায় ছিল ক্ষমতা, প্রতিহিংসা এবং বিশৃঙ্খলা।
আজকের ভাষায় যাদের পরিচয় হবে "উগ্র মৌলবাদী"। যারা ধর্মের নাম করে শাসককে অবিশ্বাস করে, অথচ নিজেরাই ন্যায়, সংযম ও শান্তিকে ছিন্নভিন্ন করে। তাদের স্লোগান ছিল ধর্মের নামে, কিন্তু কাজ ছিল ধর্মের মূলনীতি ধ্বংস করা। তারা উসমান (রাঃ)-এর ন্যায়বিচার নয়, তাঁর পতন চেয়েছিল।
অধ্যায় ৫: অবরোধ ও এক নিঃসঙ্গ খলিফা
৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।
মিশর, কুফা ও বসরা থেকে আগত বিদ্রোহীরা মদিনায় উসমান (রাঃ)-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে। ৪০ দিন অবরুদ্ধ থাকেন তিনি—পানি, খাবার পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁর সাহাবী প্রহরীরা যুদ্ধ করতে চাইলেও তিনি নিষেধ করেন: “আমি এমন রক্তপাত চাই না, যার জন্য কিয়ামতের দিনে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।”এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল এক মহান নায়কের সবচেয়ে বেদনার বর্ম।
অধ্যায় ৬: এক কুরআন, এক রক্ত
এক ফজরের সকালে, উসমান (রাঃ) বসে ছিলেন তাঁর ঘরে, কুরআন হাতে। একটি আয়াতে এসে থেমেছিলেন:
"فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ"
"আল্লাহই যথেষ্ট তোমার শত্রুদের মোকাবেলায়।"
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৩৭)
ঠিক সেই সময়, ঘরের দেয়াল টপকে বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়ে। তাঁকে ছুরিকাঘাত করে বারবার। রক্ত ছিটকে পড়ে কুরআনের সেই আয়াতেই। এটা ইতিহাসের এক অমোচনীয় ক্ষতচিহ্ন।
অধ্যায় ৬: মৃত্যুর পরও শান্তি ছিল না
এত বড় শহীদ তার জানাজা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি স্বাভাবিকভাবে। রাতের অন্ধকারে, মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী তাঁকে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে দাফন করেন। এমনকি মৃত্যুর পরেও তাঁকে অপমান করতে চেয়েছিল উগ্রদের দল। তাঁর কবর ভাঙার হুমকি দিয়েছিল অনেকে।
শহীদ রাষ্ট্রনায়ক ও আমাদের দায়
উসমান (রাঃ)-এর মৃত্যু কেবল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল না, এ ছিল এক উগ্র ধর্মান্ধতা ও সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ।
যে সমাজ সত্য যাচাই না করে গুজব বিশ্বাস করে, তারা উসমানদের হত্যা করে।
যে রাষ্ট্র ধর্মের নামে অস্ত্র তুলে নেয়, সেখানে কুরআনের রক্ষকেরাও নিরাপদ নন।
যে জাতি সহিষ্ণুতা হারায়, তাদের সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ শাসকরাও রক্ষা পায় না।
শেষ কথা:
উসমান (রাঃ)-এর জীবনের একটিই বার্তা—ক্ষমা, শান্তি, ও কুরআনের সত্য প্রতিষ্ঠা। তিনি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু শহীদ হয়েছেন। তিনি ক্ষমা করেছেন, কিন্তু তাঁর রক্ত ইতিহাসে অপরাধের নাম লিখে গেছে।
আজও সেই প্রশ্ন জেগে থাকে:
একজন শান্তিকামী কুরআনের রক্ষককে আমরা কীভাবে হত্যা করতে দিলাম?
আবির