
ছবি: জনকণ্ঠ
যাযাবর বেদে জীবন, নদীর কোল ঘেঁষে কিংবা খোলা আকাশের নিচে পলিথিন আর ছেঁড়া কাপড়ের তাঁবু বানিয়ে যাযাবরের মতো জীবন কাটাতে অভ্যস্থ বেদে সম্প্রদায়রা। নানা সমস্যা-সঙ্কট এদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। নেহাত কচুরিপানা কিংবা নদীর জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতোই আজীবন নদীর পানিতে ভেসে বেড়ায়। এ সম্প্রদায়ের নাম স্বাক্ষর করতে পারে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কারণ শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা আদি অস্ট্রাল বংশোদ্ভূত। নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় বেদেরা অনার্য। এদের এ দেশে আসা নিয়ে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। কারও মতে তারা আরাকানের মলতং শান্তা নৃগোত্র থেকে এসেছে। আবার কেউ বলে এরা সাঁওতালদের বিছিন্ন অংশ। যারা পারস্যের সাথে বেদেদের সম্পর্ক খোঁজেন তাদের মতে বেদেরা সাতমতকে আরবের আলযাদিয়া নামক স্থান থেকে এদিকে এসেছে।
পহেলা জুলাই সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহা সড়কের খোকসা ক্লাব মোড় সংলগ্ন এলাকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পলিথিন ও ছেড়া কাপর দিয়ে বানানো ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রতিটি ঝুপড়ি ঘরে রয়েছে সোলার আর টিভির ব্যবস্থা। বাপ-দাদার পুরোনো পেশাটি তারা আঁকড়ে ধরে আছেন যুগ যুগ ধরে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এ পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
কয়েকটি দল নিয়ে বেদেদের একেকটি বহর। প্রতিটি বেদে বহরে থাকে একজন সর্দার। বহরের নিয়মনীতি, প্রত্যেক দলের বাণিজ্য, এলাকা সবই নির্ধারণ করেন সর্দার। বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসবে সর্দারকে দিতে হয় অর্থ কিংবা বিশেষ উপহার। সমস্ত বহরের নেতারা মিলে গোত্রীয় সর্দার নির্ধারণ করে থাকেন।
বেদেদের বিয়ে হিন্দু-মুসলমান কারও সাথে হয় না, নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বিয়ে হয় মোল্লার কাছে ইসলামি পদ্ধতিতে। এ সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যু হলে আগেকার দিনে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হতো। আজকের দিনেও নদীর পাড়ে বা কোনো ভূ-স্বামীর পরিত্যক্ত ভিটের দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে তাদের লাশের। মরলে পোড়ায় না, কবর দেয়।
তাবিজ-কবজ বিক্রি, ঝাড়ফুঁক, শিঙ্গা লাগানো, ব্যথা দূর করতে গরুর শিং দিয়ে রক্ত টেনে আনা, দাঁতের চিকিৎসা, বানর খেলা, জাদু দেখানো আর সাপখেলা দেখিয়ে যাদের জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা সেই ছিন্নমূল, অসহায় ও অধিকার বঞ্চিতরাই হচ্ছে বেদে সম্প্রদায়। যারা রাস্তার পাশে ফাঁকা মাঠে, স্কুলের মাঠে, রেললাইনের পাশে, নদীর ধারে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। আবার একদিন উধাও হয়ে যায়; কেউ তাদের খবর রাখে না। বর্তমানে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদনের সাথে সাথে তাদের চলার পরিধিও ছোট হয়ে আসছে। অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদী; কিন্তু যাবে কোথায়?
বেদে সরদার আকন্দ আলম বলেন, বর্তমানে আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য আমরাও আর এ পেশায় থাকতে চাই না। শুধুমাত্র বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের দলের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য ইচ্ছা হয়।
বেদে সাজ্জাদ রহমান বলেন, আমাদের এ পেশা থাকতে আর ভালো লাগে না। বেদে সম্প্রদায় বলে সাধারণ মানুষরা আমাদের খোটা দেয়। আমরা সবাই মুসলমান। তাই এ পেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই।
বেদেরা আরও বলেন, আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা। আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবেই চলছে আমাদের জীবন। প্রতিটি বেদে বহর এক একটি রাজ্যের মতো কল্পনা করে এরা। সর্দার এদের রাজা। তার নিয়ন্ত্রণে চলতে হয় বহরের সবাইকে। বেদে বহরের মেয়েরাই আয়ের জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ায়। পাড়া মহল্লা ঘুরে মানুষের নানা কথা শুনে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে।
খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ্ত রায় দীপন জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান সরকার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জন্য কাজ করছে। ঠিকানাবিহীন এই যাযাবর বেদে সম্প্রদায়রা নিজ ভূমে বাস করেও পরবাসী। এই সম্প্রদায়ের যদি কেউ লেখাপড়ার সুযোগ চায় সেক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
সায়মা ইসলাম