ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে বাঙালির জীবনে নেমে আসে উপনিবেশের পুরনো স্মৃতি!

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১২:৪১, ৩০ জুন ২০২৫

যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে বাঙালির জীবনে নেমে আসে উপনিবেশের পুরনো স্মৃতি!

ছ‌বি: সংগৃহীত

ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলোতে আমরা যতই চোখ বুলাই না কেন, সেখানে রাজা-নবাবদের যুদ্ধ, কূটনীতি কিংবা বিজয়ের গৌরবগাথাই বেশি ঠাঁই পায়। কিন্তু এসব কাহিনির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে সেই মানুষগুলোর গল্প, যাদের ঘর পুড়েছে, সন্তান হারিয়েছে, অথবা খাদ্যের সন্ধানে দিনের পর দিন কাটিয়েছে অনাহারে। সেসব সাধারণ মানুষের জীবনের ছাপ ইতিহাসের পাতায় ততটা দেখা যায় না।

১৬৯০ সালে যখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদল গঙ্গার তীরে দুটি গ্রাম কিনে বাণিজ্যের যাত্রা শুরু করল, তখন বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে এই ছোট্ট বিনিয়োগ একদিন উপনিবেশের বিস্তৃত ছায়া ফেলবে গোটা বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর।

ইংরেজরা একে একে কলিকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম গড়ে তোলে, নদীর ঘাটে বন্দরের পর বন্দর বসায়। নবাব-জমিদারদের সঙ্গে নানা ধরনের চুক্তিতে তারা জমি নেয়, সামরিক শক্তি গড়ে তোলে। কিন্তু তখনও তারা ছিল বাণিজ্যিক শক্তি, শাসক নয়। সাধারণ মানুষ তখনো ভাবতো, কিছু সাহেব এসেছে ব্যবসা করতে— তাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি তেমন কিছু করার নেই।

তবে সেই ভাবনার কল্পজগৎ চূর্ণ হতে শুরু করে ১৭৩৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে। সে বছর যে প্রলয়ঙ্করী ঝড় বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, তা শুধু প্রকৃতির রোষ ছিল না— ছিল জীবনের তাসভবনের একেবারে ভিত্তি কেঁপে ওঠার মুহূর্ত। কলিকাতার নদীবন্দর, সদ্য গড়ে ওঠা বাণিজ্যকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। শত শত জাহাজ নদীর তলানিতে ডুবে যায়। সেই সঙ্গে ডুবে যায় বহু পরিবার, তাদের জীবিকা, তাদের ভবিষ্যৎ। যে মানুষগুলো নদীর পাশে জেলে ছিল, কৃষক ছিল, কিংবা শ্রমিক হিসেবে নতুন শহরে কাজ খুঁজতে এসেছিল— তারা হারায় বাড়ি, খাবার, নিরাপত্তা। কিন্তু আমরা ইতিহাসে এই মানুষগুলোর কথা খুব কমই পড়ি।

এরপর আসে ১৭৪২ সাল। এবার প্রকৃতির রোষ নয়, মানুষের ভয়ঙ্কর রূপ। মহারাষ্ট্র থেকে আসতে থাকে মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ। তারা হানা দেয় বাংলার সমৃদ্ধ জনপদে। লুট, হত্যা, অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে দেয় এক অস্থিরতা, যার ভয় এখনো লোককথায় বেঁচে আছে— “খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো— বর্গী এলো দেশে।” এই ছড়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভীতিকর এক রাতের স্মৃতি, যখন মানুষ ঘুমাতেও ভয় পেত। আর ইতিহাস তখনো ব্যস্ত ছিল রাজা কার সঙ্গে চুক্তি করলো, নবাব কী পদক্ষেপ নিলো, কিংবা ইংরেজরা কীভাবে এই অস্থিরতাকে কাজে লাগাল।

অবশেষে আসে ১৭৫৭ সালের সেই বিখ্যাত পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন, ইংরেজদের বিজয়, বাংলায় উপনিবেশিক শাসনের সূচনা। ইতিহাসে এটিকে এক বাঁক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সে বছর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল যুদ্ধ নয়, এক মারণব্যাধি ম্যালেরিয়া। গ্রামে গ্রামে মানুষ মরেছে, পরিবারে চলেছে শোকের মাতম। কেউ জানে না কীভাবে এই রোগ ঠেকাবে। খাদ্যের অভাব, রোগ, মৃত্যু— এই ছিল তাদের দিনলিপি। পলাশীর যুদ্ধ তাদের কাছে ছিল দূরের রাজনীতির ঘটনা, যেমন আজ শহরের কারও কাছে দূরের এক গ্রামের খরা, দুর্ভিক্ষ বা বন্যা।

এই যে ১৭৩৭ থেকে ১৭৫৭— এই বিশ বছর সময়কাল, যাকে আমরা ইতিহাসে দেখি প্রাক-উপনিবেশিক অস্থিরতার অধ্যায় হিসেবে, সেখানে কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য এক এক দুঃস্বপ্নের সময়। ঝড়, ডাকাতের আক্রমণ, রোগ সব মিলিয়ে তারা প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছিল। আর সেই লড়াই ছিল নিঃশব্দ, প্রায় অদৃশ্য কিন্তু তীব্রভাবে বাস্তব।

তাই আমরা যখন এই সময়ের ইতিহাস পড়ি, কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক ঘটনার ভেতরে আটকে গেলে চলবে না। আমাদের দরকার সেই চোখ, যা দেখে একটি বিধ্বস্ত পরিবারের ভাঙা চালা, একটি মায়ের ছেলের মৃত্যুর কান্না, অথবা এক কৃষকের ফসলহীন জমির হতাশা। কারণ এইসব গল্পও ইতিহাস— মানবিক ইতিহাস, যা কেবল কাগজে নয়, রক্ত-মাংসে গাঁথা।

উপনিবেশের পুরনো স্মৃতি মানে শুধু যুদ্ধ আর বিজয়ের গল্প নয়। এর মানে ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে যাওয়া বাড়ি, বর্গীর তাণ্ডবে পুড়ে যাওয়া গ্রাম, কিংবা ম্যালেরিয়ায় নিঃশেষ হওয়া পরিবার। এইসব স্মৃতি নিয়ে গড়ে ওঠে একটি জাতির জীবনবোধ, তার সাহস, তার টিকে থাকার তীব্রতা।

এই ইতিহাসকে যদি আমরা মানবিক চোখে না দেখি, তাহলে সেটি অসম্পূর্ণ থাকে। কারণ বাংলার ইতিহাস শুধু নবাব বা ইংরেজদের গল্প নয়— এটা বেঁচে থাকা মানুষগুলোরও গল্প, যারা যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে থেকেও টিকে থেকেছে, লড়েছে, আর ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে আজকের এই জনপদ।

(‘কলিকাতার সেকাল-একাল’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী লিখিত)

লেখক: সাংবাদিক ([email protected])

এম.কে.

×