
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের বড় শরীফপুর গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে ৪০০ বছরের পুরনো এক ঐতিহাসিক স্থাপনা—বড় শরীফপুর শাহী জামে মসজিদ। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন এই মসজিদটি আজও আগের রূপেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রতিদিন হাজারো মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। পেছনে রয়েছে ২৭ বিঘা আয়তনের প্রশান্ত নাটেশ্বর দিঘি, যা স্থানীয়দের কাছে এক দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত।
স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাস
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৪.৪৮ মিটার এবং প্রস্থ ৫.৯৪ মিটার। তিনটি গম্বুজের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি তুলনামূলকভাবে বড়, প্রতিটিতে পদ্মফুলের নকশা। পূর্বদিকে তিনটি খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ এবং পশ্চিমে সমানসংখ্যক মিহরাব রয়েছে। দরজাগুলোর ঠিক বিপরীতে অবস্থিত মিহরাবগুলোর মধ্যেও কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড়। চার কোনায় অষ্টভুজাকার চারটি মিনার ও কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপরেও রয়েছে দুটি মিনার। গম্বুজের ভেতরের অংশ পাতার এবং বাইরের অংশ চক্রাকার নকশায় শোভিত।
মসজিদের সামনের দেয়ালে একটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে, যার পাঠোদ্ধার পুরোপুরি সম্ভব না হলেও স্থানীয়দের মতে, ১৬২০-১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে কোতোয়াল পদমর্যাদার হায়াতে আবদুল করিম নামের এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই কারণেই এটি ‘কোতোয়ালি মসজিদ’ নামেও পরিচিত।
লোকবিশ্বাস ও ঐতিহ্য
হায়াতে আবদুল করিম সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত: কেউ বলেন তিনি নাটেশ্বর রাজার কর্মকর্তা ছিলেন, কেউ বলেন তিনি দরবেশ সৈয়দ শাহ শরীফ বাগদাদীর মুরিদ ছিলেন। মসজিদের পাশেই রয়েছে তাঁর মাজার।
সংরক্ষণ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর
১৯৫৯ সালে মসজিদটি সরকারিভাবে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৬০-এর দশকে এবং সর্বশেষ ছয় বছর আগে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে। তবে বর্তমানে মসজিদে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন হলেও অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থানীয় কমিটি স্বতন্ত্রভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন,
“প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরই এখানে ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতনসহ সকল দেখভাল করে। তবে এখন কিছু অংশে সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু তারা অনুমতি না দেওয়ায় কিছুই করা যাচ্ছে না।”
ধর্মীয় ও পর্যটন গুরুত্ব
মসজিদটির পেছনে বিস্তৃত ৩৫.২৯ একর আয়তনের নাটেশ্বর দিঘি শুধু একটি প্রাকৃতিক জলাধার নয়, বরং এলাকাবাসীর জন্য এক আবেগঘন ঐতিহ্যের প্রতীক। এর চারপাশে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র—এমনটাই বিশ্বাস স্থানীয়দের।
ইমাম মোহাম্মদ সামছুদ্দোহা বলেন,
“প্রতিদিন অনেক মানুষ মসজিদ দেখতে আসেন। বিশেষ করে শুক্রবার দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা আসেন নামাজ পড়তে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি মসজিদের সৌন্দর্য রক্ষা করতে।”
Jahan