কেরানীগঞ্জ: ইতিহাস, সম্ভাবনা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বে এক পরিবর্তনশীল জনপদ

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, রাজধানী ঢাকা লাগোয়া এই জনপদটি যেন আধুনিক নগর উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের এক মিশ্র রূপ। ইতিহাসের পাতায় কেরানীগঞ্জ পরিচিত ছিল মূলত প্রশাসনিক এবং গুদামঘর-ভিত্তিক এলাকাসমূহের জন্য। কিন্তু আজকের কেরানীগঞ্জ শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা এবং নাগরিক জীবনের এক দ্রুত রূপান্তরশীল চিত্র।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও নামকরণের পেছনের গল্প

কেরানীগঞ্জ নামটি এসেছে ‘কেরানি’ শব্দ থেকে। ব্রিটিশ আমলে যখন কোম্পানির কেরানি বা হিসাবরক্ষকেরা নদী পার হয়ে এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন, তখন এলাকাটির নাম হয়ে যায় 'কেরানিদের গঞ্জ'—যা পরবর্তীতে কেরানীগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে।

শিল্পাঞ্চল ও কারখানার বিস্তার

আজকের কেরানীগঞ্জ একটি বিকাশমান শিল্পাঞ্চল। বিভিন্ন গার্মেন্টস, প্লাস্টিক, কারখানা ও লোহা-লক্কড়ের ব্যবসার জন্য এলাকাটি পরিচিতি পেয়েছে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, আগানগর, জিনজিরা ও কালিন্দী এলাকায় শত শত ছোট-বড় কারখানা প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জুগিয়ে চলেছে।

তবে এসব শিল্পকারখানা উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ ও যানজটেরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সামাজিক অবকাঠামো ও নাগরিক সেবা

কেরানীগঞ্জে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হলেও এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি কলেজ ও হাসপাতাল থাকলেও মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা পাওয়া এখনো অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জ। জিনজিরা, কোন্ডা, তেঘরিয়া এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন আজও বড় সমস্যা।

অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

কেরানীগঞ্জে মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে র‌্যাব ও পুলিশ প্রায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। র‌্যাব-১০, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার তৎপরতায় কিছুটা হলেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে অপরাধীদের পুনরাবৃত্তি ও রাজনৈতিক আশ্রয়ে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়।

পরিবহণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মা সেতুর সংযোগে কেরানীগঞ্জে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে। নদী পারাপারের জন্য লঞ্চ ও ট্রলার সার্ভিস এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে জিনজিরা-শ্যামপুর ব্রিজ এখনও একটি স্বপ্ন মাত্র। বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ আরো গতিশীল হবে।

আশার আলো ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

কেরানীগঞ্জ এখন একটি সম্ভাবনার নাম। সরকারের পরিকল্পিত “কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন” প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এটি ঢাকার বিকল্প নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সুশাসন, পরিবেশ সচেতনতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ থাকলে কেরানীগঞ্জ হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম মডেল উপজেলা।