
বাংলা গানের জাদুকরী গীতিকার ও সুরকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আধুনিক ও চলচ্চিত্র সংগীতে প্রেম, দ্রোহ ও আবেগের স্পর্শে যে আলো ছড়িয়েছেন, তা আজও বাংলার মানুষের হৃদয়ে দীপ্ত। তাঁর লেখা ও সুর করা অসংখ্য গান কালজয়ী হয়ে আছে বাংলাসঙ্গীতের ইতিহাসে।
৯০ দশকে শার্টের বোতাম খোলা, চোখে রঙিন চশমা পরা যুবকের প্রেম নিবেদন করা যে বাংলা গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরত, সেগুলোর অনেকটাই ছিল তাঁর সৃষ্টি। অথচ উপমহাদেশের এই মহান গীতিকারের স্মৃতিচিহ্ন আজ নেই তাঁর পৈতৃক ভিটা পাবনায়।
১৯২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে। তাঁর বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক। সেই সূত্রেই তাঁর নাম রাখা হয় গৌরীপ্রসন্ন। ডাকনাম ছিল ‘বাচ্চু’।
গৌরীপ্রসন্নের পৈতৃক বাড়িটি এখন ফরিদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অংশ। ১৯৮০’র দশকেও কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছিল, যা এখন আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি অনেকে জানেনই না, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন পাবনার সন্তান।
তিনি ছিলেন বাংলা গীতিকলার এক অগ্রপথিক, যাঁর শব্দচয়নে ছিল অসাধারণ অভিনবত্ব ও আবেগ। তাঁর লেখা "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই" গানটি বিবিসির করা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাঁর লেখা গান “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি...” এবং “মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে” আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাদায়ী গানের অংশ।
তাঁর লেখা ও সুর করা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে: "এই পথ যদি না শেষ হয়", "এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে", "তুমি না হয় রহিতে কাছে", "আমার গানের স্বরলিপি", "ও নদীরে", "এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়", "আমি যামিনী তুমি শশী হে", "নীর ছোট আকাশ তো বড়", "প্রেম একবার এসেছিল নীরবে" এবং আরও বহু কালজয়ী সৃষ্টি।
১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট তিনি কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে “মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা” প্রদান করে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি শেষবারের মতো নিজ পৈতৃক ভিটায় আসেন। কিন্তু এত বছরেও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাংলার গানে প্রেম, সংগ্রাম ও স্বদেশপ্রেমের যে দীপ্তি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার রেখে গেছেন, তা আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলো দিয়ে যায়।
নুসরাত