ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

পদ্মার বুক চিরে স্থাপত্যের চমক: হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অমর গাথা

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিরাজদিখান, মুন্সিগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৫ জুন ২০২৫

পদ্মার বুক চিরে স্থাপত্যের চমক: হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অমর গাথা

ছবি: জনকন্ঠ

পদ্মা নদীর উত্তাল জলরাশির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এক প্রকৌশল বিস্ময়—হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এটি শুধু একটি রেলসেতু নয়, এটি এক ইতিহাস, এক জীবন্ত উপাখ্যান। শত সহস্র ট্রেনের গর্জনের নিচে দিয়ে যেন আজও বয়ে চলে পূর্ব বাংলার প্রাচীন স্মৃতি, স্বাধীনতার উন্মাদনা, আর প্রকৌশল কাব্যের এক মহাকাব্যিক ধারা।

১৯০৯ সালে যখন ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা পদ্মার বুক চিরে একটি রেলসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন, তখন পদ্মা ছিল ভয়ংকর, বন্যাপ্রবণ ও নিত্যনতুন ভাঙনের প্রতীক। এই নদীর উপর এত বড় সেতু নির্মাণ সে সময়কার প্রযুক্তির জন্য ছিল একরকম আত্মহত্যার শামিল। তবুও তারা এগিয়েছিল—যেমন সব সাহসী স্বপ্নবাজরা এগিয়ে যায়।

এই মহাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ২৪,৪০০ শ্রমিক ও প্রকৌশলী। প্রকল্পটির নকশা করেন স্যার এস এম রেলডলস, নির্মাণের নেতৃত্বে ছিলেন স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস। ব্রিটেন থেকে আনা হয়েছিল লোহা ও স্টিল; অর্থ ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ভারতীয় রুপি—যা সে সময়কার অর্থনীতিতে ছিল এক বিপুল বিনিয়োগ। শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে পূর্ণতা পায় সেতুটি।

এই সেতুর প্রতিটি স্প্যান যেন কথা বলে। ১৫টি মূল স্প্যান ও ৬টি ল্যান্ড স্প্যান নিয়ে তৈরি ব্রিজটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৮ কিলোমিটার। পাবনার পাকশী থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত এই ব্রিজ এখনো দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের রেল সংযোগের অন্যতম ভরসা। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ও পণ্য ট্রেন পার হয় এই সেতুর ওপর দিয়ে।

কিন্তু এর স্থাপত্যের দম্ভ শুধু দৈর্ঘ্যে নয়, রয়েছে এর স্থায়িত্বে। শত বছর পেরিয়ে গেলেও ব্রিজটি আজও কর্মক্ষম। না আছে মরিচা ,না আছে ক্লান্তি। প্রকৌশলের পাঠশালায় এটি এক ‘জীবন্ত ক্লাসরুম’, যা এখনও বিস্ময় জাগায় রেল প্রকৌশলীদের মধ্যে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ব্রিজও হয়ে উঠেছিল এক কৌশলগত কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী যখন পিছু হটে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন এক নাটকীয় মুহূর্তে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ব্রিজটির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। ১২ নম্বর স্প্যান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যুদ্ধশেষে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত তা মেরামত করে। আবার চালু হয় রেল চলাচল—যেন স্বাধীন বাংলার প্রাণ ফিরল এই ব্রিজের বুক দিয়ে।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজ আর শুধুই একটি রেলসেতু নয়। এটি বাংলাদেশের রেল ইতিহাসের এক অমর দলিল, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলা আত্মপরিচয়ের অংশ। এটা দেখলেই বোঝা যায়, সময় শুধু ক্ষয়ে দেয় না, কিছু কিছু কীর্তিকে আরও গাঢ় করে তোলে।

শুধু প্রযুক্তির জয় নয়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আমাদের বলে দেয়—আমরা ইতিহাসের ধারক, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আর পদ্মার বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোহালক্কড়ের স্থাপত্য কেবল যাত্রার নয়, তা আমাদের অতীতের গর্ব, বর্তমানের সম্পদ, আর ভবিষ্যতের প্রেরণা।

Mily

×