ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

গাহুআ: মরুভূমির আগুনে সেদ্ধ আরব সভ্যতা, যার ধোঁয়ায় উড়ে বেদুইন গল্প

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৪ জুন ২০২৫

গাহুআ: মরুভূমির আগুনে সেদ্ধ আরব সভ্যতা, যার ধোঁয়ায় উড়ে বেদুইন গল্প

ছবি: সংগৃহীত

মরুপ্রান্তরের বাতাসে যখন বালুর ঢেউ উঠে, তখন সেই নীরবতায় যে কফির ঘ্রাণ ভেসে আসে—তাকে বলে গাহুআ। 
সেই কফি পরিবেশন করা হয় ‘দাল্লা’ নামের এক মনোহর পিতলের পাত্রে। খেজুর হাতে ধরে যে বুড়ো আরব অতিথির হাতে ‘ফিনজান’ তুলে দেন—তাঁর মুখে থাকা নীরব হাসিই বলে দেয়, “আসসালামু আলাইকুম, তুমি আমার মরুভূমির ভাই”।

আরব ইতিহাস বলে, অতিথি এলে ঘরের মালিক আগে রুটি নয়, খেজুর নয়—কফির আগুন জ্বালাতেন।
প্রাচীন বেদুইন গোত্রগুলোর মরুভূমি-জীবনে অতিথি মানে ছিল আল্লাহর রহমত। আর সেই রহমতের প্রতীক ছিল এই গাহুআ।

প্রতিটি গাহুআর দানার পেছনে লুকিয়ে থাকে কয়েক শতকের ইতিহাস। এই কফি শুধু মুখের তৃপ্তি নয়—এটি স্মৃতি, এটি শ্রদ্ধা, এটি মরুভূমির ভাষাহীন ভালোবাসা।

গাহুআ প্রস্তুতির শুরুটা এক নিঃশব্দ পূজা। প্রথমে নির্বাচন হয় উৎকৃষ্ট কফি বীজ। হালকা আঁচে ভাজা হয় অগভীর প্যানে, যেন তার সুবাস হারিয়ে না যায়। তারপর মর্টারে মুদ্দাক দিয়ে কফি চূর্ণ করা হয়—প্রতিটি আঘাতে যেন পুরুষের শক্তি আর নারীর কোমলতা একসাথে মিশে যায়।

এরপর সেই গুঁড়ো কফি ‘দাল্লা’য় পানি দিয়ে চুলায় বসানো হয়। মিশে যায় এলাচের সৌরভ, জায়ফলের মাদকতা, আর মরুর নিঃসঙ্গতা। ধীরে ধীরে সেই দাল্লা থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে—সেই ধোঁয়া যেন অতীতের বেদুইন গল্প নিয়ে ফিরে আসে আধুনিক শহরের হোটেলে, মজলিসে, পরিবারে।

গাহুআ পরিবেশনের নিয়মেও লুকিয়ে আছে আরবদের সমাজতাত্ত্বিক দর্শন। প্রথমে পরিবেশন করা হয় সবচেয়ে সম্মানিত বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে। কফি ঢালা হয় ফিনজানের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত—এটি নম্রতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।অতিথি কফি পান করে কাপে একবার হালকা ঝাঁকি দিলে বোঝা যায়—তিনি পরিতৃপ্ত।

এটি ছিল এক নিঃশব্দ অথচ শক্তিশালী ভাষা—যেখানে কোনো শব্দ ছাড়াই বয়ে যায় কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

২০১৫ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার ও ওমান মিলে ইউনেস্কোতে একটি আবেদন জমা দেয়।
সেই আবেদনে তারা বলেছিল—“গাহুআ আমাদের কফি নয়, আমাদের আত্মার একটি টুকরো।” ইউনেস্কোও সাড়া দেয়। আরবি কফি, মজলিস ও রজফা—এই তিনটি ঐতিহ্যকে অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয়।
এই স্বীকৃতি শুধু মরুভূমিকে নয়, পুরো আরব জাতিকে এক চুমুক গর্ব এনে দেয়।

আরব সমাজে যেখানে কথার চেয়ে নীরবতা বেশি মূল্যবান, সেখানে গাহুআ হয়ে ওঠে এক নীরব কবিতা।
এই কফির প্রতিটি ঢেউ বয়ে আনে স্মৃতির মরু, আতিথেয়তার রোদেলা বিকেল, আর সম্পর্কের গভীরতা।
এই কফি শুধু অতিথির জন্য নয়—এটি গৃহস্থের হৃদয়ের দরজা খুলে দেয়।

গাহুআ হচ্ছে মরুর কবিতা, দাল্লা তার কলম, আর ফিনজান সেই কাগজ—যার প্রতিটি চুমুকে লেখা থাকে আরবদের অমর আতিথেয়তা। আজ যখন আধুনিক ক্যাফেতে এসপ্রেসো আর ক্যাপুচিনো পরিবেশিত হয়, তখনও আরবের মজলিসে দাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন এক বৃদ্ধ—চোখে ইতিহাসের আলো, হাতে কফির কাপ, আর ঠোঁটে এক চিরন্তন হাসি।

আবির

×