
পওয়ালগড়ের বাঘ শিকারের পর জিম করবেট। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
একটি বাঘিনী। একটি জনপদ। আর একটি রক্তাক্ত কিংবদন্তি—যার শিকার হয়েছিল ৪৩৬ জন মানুষ। ইতিহাসের পাতায় ভয়াল নাম—‘চম্পাবতের শয়তানী’। উত্তর ভারতের কুমায়ুন অঞ্চলে দিনের আলোয় মানুষ গিলত যে বাঘিনী, তাকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল সেনা, ব্যর্থ হয়েছিল শিকারির দলও।
অবশেষে এগিয়ে আসেন এক মানুষ—জিম করবেট। আর সেখানেই জন্ম নেয় একটি নতুন অধ্যায়—শিকার থেকে সংরক্ষণের পথে এক শিকারির বিবর্তনের গল্প।
১৮৭৫ সালে নৈনিতালে জন্ম জিম করবেটের। তাঁর জীবন শুরু হয় মানুষখেকো বাঘ ও চিতার শিকারি হিসেবে, আর শেষ হয় বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের অগ্রদূত হিসেবে। এই পথপরিক্রমার সূচনা হয়েছিল একটি বাঘিনীর হাত ধরে—চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘিনী।
বাঘিনীটির প্রথম শিকার ১৮৯০ সালের দিকে, নেপালের রুপাল গ্রামে। আহত হওয়ার পর তার মুখের দুটি ক্যানাইন দাঁত ভেঙে যায়—যা হিংস্র প্রাণীদের প্রধান অস্ত্র। দাঁতের অক্ষমতায় সে বেছে নেয় সহজ শিকার—মানুষকে।
সেনাবাহিনী ও শিকারির দলও তাকে থামাতে পারেনি। সারদা নদী পার হয়ে সে ঢুকে পড়ে ভারতের চম্পাবত জেলায়। দিনের বেলায়, চোখের সামনেই মানুষকে আক্রমণ করত সে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের, যারা কাঠ কুড়াতে বা গরু চড়াতে যেত।
১৯০৭ সালে করবেটের কাছে অনুরোধ আসে বাঘিনীটিকে হত্যার জন্য। তখন পর্যন্ত বাঘিনীর শিকারের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ৪৩৫।
করবেট রাজি হন দুটি শর্তে—পুরস্কার প্রত্যাখ্যান এবং একক অভিযান।
পালি গ্রামে অনুসন্ধান শুরু করে করবেট বাঘিনীর রক্তাক্ত ছাপ ধরে জঙ্গলে ঢোকেন। প্রথম গুলিতে বাঘিনী পালায়। পরে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাকে বের করা হয়। কয়েক দফা গুলির পর, আহত বাঘিনী করবেটের দিকে তেড়ে আসে। শেষ মুহূর্তে তহশীলদারের শটগান দিয়ে ছোড়া গুলিতে থেমে যায় এক যুগান্তকারী হত্যাযজ্ঞ।
মৃত বাঘিনীর মুখ পরীক্ষা করে দেখা যায়—ভাঙা ক্যানাইন দাঁতের জন্যই সে মানুষখেকো হয়েছিল। করবেট উপলব্ধি করেন, প্রকৃতি নয়, মানুষের ভুলই জন্ম দিয়েছে এমন হিংস্রতার।
এরপর করবেট হয়ে ওঠেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের মুখপাত্র। ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যান—আজকের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক—তাঁরই প্রচেষ্টার ফল।
ভারতের স্বাধীনতার পরে করবেট চলে যান কেনিয়ায়। কিন্তু চম্পাবতের গল্প রয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়—কাহিনির মতো নয়, রক্তে লেখা বাস্তব ইতিহাস হিসেবে।
একদিকে ৪৩৬টি জীবন, অন্যদিকে করবেটের বিবেক—আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘চম্পাবতের শয়তানী’।
কিন্তু এই গল্প শুধুই এক হিংস্র প্রাণীর নয়, এ এক গভীর মানব-বন্যপ্রাণ সংঘাত, এক ব্যর্থ শিকার-সংস্কৃতির নির্মম পরিণতি এবং এক শিকারির বিবেকের জাগরণের ইতিহাস।
শিহাব