ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

ইহুদি ধর্ম ও ইসলাম: এক সৃষ্টিকর্তা, এক শেকড়, তবু ভিন্ন পথ

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:২১, ১৯ জুন ২০২৫

ইহুদি ধর্ম ও ইসলাম: এক সৃষ্টিকর্তা, এক শেকড়, তবু ভিন্ন পথ

ছবি: সংগৃহীত

ইহুদি ধর্ম ও ইসলাম—উভয়ই আব্রাহামিক (ইব্রাহিম আঃ) ধর্ম। তারা বিশ্বাস করে একই ঈশ্বরে, যিনি এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু ইতিহাস, নবী-প্রেরিত ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় বিধান এবং বিশ্বাসে রয়েছে অনেক পার্থক্য। অনেকটা যেন—একই বৃক্ষের দুই ডাল, একে অপরের নিকট আত্মীয় হলেও পথচলায় নানা মতবিরোধ।

 

🔷 একক স্রষ্টা বিশ্বাস: "এক আল্লাহ" বনাম "এলোহিম"

দুই ধর্মই এক ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখে:

  • ইসলাম বলে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” — আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়।
  • ইহুদি ধর্মে বলা হয়, “শেমা ইস্রায়েল, আডোনাই এলোহেনু, আডোনাই এখাদ” — হে ইস্রায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু এক।

উভয় ধর্মই তৌহিদ বা একেশ্বরবাদী।

 

🔷 পবিত্র গ্রন্থ ও কিতাবের ঐতিহ্য

  • ইসলাম অনুসারে, তাওরাত (Torah) ছিল মুসা (আ.)-এর প্রতি প্রদত্ত কিতাব।
  • ইহুদিরাও মনে করে, তোরাহ তাদের ধর্মীয় ও আইনি ভিত্তি।

তবে ইসলাম বিশ্বাস করে—তাওরাতের আসল সংস্করণ বিকৃত হয়েছে, আর কোরআন হল চূড়ান্ত ও সংরক্ষিত কিতাব।

উভয় ধর্মেই তাওরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কিতাব, কিন্তু মুসলমানরা সেটির আসলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে।

 

🔷 ধর্মীয় বিধান ও আইন (শরিয়াহ বনাম হালাখা)

  • ইসলামে শরিয়াহ আইন রয়েছে কোরআন, হাদিস ও কিয়াসের ভিত্তিতে।
  • ইহুদি ধর্মে রয়েছে হালাখা নামক আইন, যা তোরাহ ও রাব্বিনিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে গঠিত।


দুই ধর্মেই খাদ্য আইন (হালাল/কোশের), পোশাক, বিশ্রামের দিন ইত্যাদিতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। ধর্মীয় আইনে উভয় ধর্মেই রয়েছে বিস্তারিত নির্দেশনা ও নিয়মানুবর্তিতা।


🔷 উপাসনা পদ্ধতির সাদৃশ্য

  • মুসলমানরা দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কাবার দিকে মুখ করে।
  • ইহুদিরা দিনে ৩ বার প্রার্থনা করে জেরুজালেমমুখী হয়ে।

নির্দিষ্ট সময়, দিক ও ধোয়ার (ওযু/মিকভে) ব্যবস্থাসহ প্রার্থনার ধরনেও মিল রয়েছে উভয় ধর্মে।

 

🔷 রোজা ও উপবাস

  • ইসলামে রমজান মাসে এক মাস রোজা ফরজ।
  • ইহুদি ধর্মে রয়েছে ইয়োম কিপ্পুর সহ অন্যান্য উপবাসের দিন।

আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে উপবাস দুই ধর্মেই গুরুত্বপূর্ণ।


🔷 মক্কা বনাম জেরুজালেম

  • ইসলাম: কাবা (মক্কা) — কিবলা ও হজের কেন্দ্র।
  • ইহুদি: জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট ও প্রাচীর (Western Wall) তাদের প্রধান পবিত্র স্থান।

দুটি ধর্মেই একনিষ্ঠতা ও পবিত্র নগরীর ধারণা, তবে ভিন্ন কেন্দ্রে। 

 

পার্থক্য ও তার কারণ:

১. নবী ও নবুয়তের ধারা

  • ইসলাম: হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে মানা হয়। তিনি চূড়ান্ত ও সার্বজনীন বার্তা নিয়ে আসেন।
  • ইহুদি ধর্ম: মুসা (আ.)-কে প্রধান নবী মনে করা হয়। তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী বলে স্বীকার করে না।

ইহুদি ধর্ম মূলত একটি জাতিকেন্দ্রিক ধর্ম, যেখানে ঈশ্বরের চুক্তি (covenant) শুধু ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে। ইসলাম এক সার্বজনীন ধর্ম, যেখানে নবুয়ত সব জাতির জন্য প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থেকেই নবুয়তের স্বীকৃতিতে বিভেদ।

২. ধর্মগ্রন্থের বিশুদ্ধতা নিয়ে মতবিরোধ

  • ইসলাম: তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসা (আ.)-কে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা বিকৃত হয়।
  • ইহুদি ধর্ম: তোরাহই তাদের আদি ও চূড়ান্ত গ্রন্থ, যা মুসা-নির্দিষ্ট ও ঐতিহ্যগতভাবে সংরক্ষিত।

ইসলাম কোরআনকে সংরক্ষিত ও চূড়ান্ত কিতাব হিসেবে গণ্য করে। মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গিতে তাওরাত ও ইনজিল মানবীয় হস্তক্ষেপে বিকৃত হয়েছে। পক্ষান্তরে ইহুদি ধর্ম নিজস্ব ঐতিহ্যকে অপরিবর্তনীয় ও ঐশী বলেই ধরে নেয়।

৩. উপাসনা ও উপাসনালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি

  • ইসলাম: মসজিদে জামাতে নামাজ ফরজ, কাবা মুখী।
  • ইহুদি ধর্ম: সিনাগগে প্রার্থনা, জেরুজালেমমুখী প্রার্থনা, কিন্তু উপাসনার ধরনে তুলনামূলকভাবে জটিল ও আনুষ্ঠানিক।

ইসলাম শুরু থেকেই একটি সংগঠিত ও রাজনৈতিক-ধর্মীয় সমাজব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ইহুদি ধর্ম মূলত উপনিবেশিত ও নির্যাতিত জাতির ধর্ম হওয়ায় তাদের ধর্মাচরণ অনেকটাই রক্ষণশীল ও প্রতীকভিত্তিক।

৪. জাতিগত বনাম সার্বজনীন ধর্মচিন্তা

  • ইসলাম: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মুসলমান হওয়া যায়।
  • ইহুদি ধর্ম: এটি একপ্রকার জাতিসত্তার ধর্ম—ইহুদি হয়ে জন্মাতে হয়, গ্রহণ প্রক্রিয়া কঠিন।

ইসলাম একটি প্রসারিত মিশনারি ধর্ম, ইহুদি ধর্ম জাতিগত ও বংশগত সচেতন ধর্ম। তাই নবুয়ত, কিতাব ও জাতির নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকাটাই স্বাভাবিক।

৫. ঈসা (আ.) ও যিশুর ভূমিকা

  • ইসলাম: ঈসা (আ.) মহান নবী, জীবিত অবস্থায় উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, পুনরায় আসবেন।
  • ইহুদি ধর্ম: ঈসা বা যিশু খ্রিস্টকে নবী বা খ্রিষ্ট হিসেবে মানে না।

ঈসা (আ.)-কে কেন্দ্র করে খ্রিষ্টধর্ম তৈরি হওয়ায় ইহুদিরা তাঁকে ‘ভ্রান্ত প্রচারক’ হিসেবে দেখে। ইসলাম ঈসাকে নবী মেনে নেয়, কিন্তু খ্রিস্টানদের অতিরঞ্জন প্রত্যাখ্যান করে।

ইহুদি ও ইসলাম ধর্মের মিলের শেকড় রয়েছে পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম (আ.)-এর ঐতিহ্যে। কিন্তু তাঁদের পথ আলাদা হয়েছে নবুয়ত, জাতিগত পরিচয় ও ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত দৃষ্টি ভিন্নতার কারণে।

তবুও, একক স্রষ্টা, নৈতিক শৃঙ্খলা, ধর্মীয় জীবন ও আখিরাতের বিশ্বাস—এই চার স্তম্ভ উভয় ধর্মকে একই আধ্যাত্মিক বৃন্তে বেঁধে রেখেছে।

Mily

×