ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

বর্ষা মানেই সাপের ভয়: কতটা প্রস্তুত আমরা?

রুমান হাসান তামিম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৯ জুন ২০২৫

বর্ষা মানেই সাপের ভয়: কতটা প্রস্তুত আমরা?

ছবিঃ সংগৃহীত

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। গ্রামের একটি ছেলে মেঝেতে শুতে যাচ্ছিল। অন্ধকারে হঠাৎ পায়ে কামড়ে বসে বিষাক্ত সাপ। আতঙ্কে ভীত পরিবার প্রথমে ঝাড়ফুঁকের ওঝা ডাকে, পরে হাসপাতালে নিয়ে ছুটে যায়। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জানিয়ে দেওয়া হয়—সাপের বিষের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) নেই। সেই ছেলেটিকে শহরে পাঠানো হয়, কিন্তু শহরে পৌঁছার আগেই হারিয়ে যায় একটি তরতাজা প্রাণ।

এই গল্পটা কল্পনা হতে পারে, কিন্তু এই ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের শত শত গ্রামের জন্য এক নির্মম বাস্তবতা। এবং বাস্তবতাটি এমন—সাপ কাটে গ্রামে, কিন্তু ভ্যাকসিন থাকে শহরে!

বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। আকাশে মেঘ, মাঠে পানি। শুধু ফসল আর সবুজ নয়—সাথে আছে আরেক ভয়: সাপের কামড়। জুন-জুলাই মাস মানেই সাপের বিষে মৃত্যুর মৌসুম। প্রতি বছর এই সময়ে দেশের গ্রামাঞ্চলে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।


কেন বর্ষায় বাড়ে সাপের কামড়?

১. বর্ষায় বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে সাপের বাসস্থান ডুবে যায়, ফলে তারা আশ্রয় নেয় বাড়ির আশেপাশে, রান্নাঘরে, বিছানায়, শস্য গোলায়।

২. রাতে শোয়ার সময় সাপ মেঝেতে ঘোরাফেরা করে, আর তখনই ঘটে কামড়।

৩. খেতে কাজ করা কৃষক, শিশুরা পা দিয়ে সাপের উপর হাঁটলে আত্মরক্ষার জন্য সাপ কামড়ায়।

৪.পানিতে চলাচলের সময় সাপের উপস্থিতি বোঝা যায় না, ফলে হঠাৎ কামড়ে দেয়।


পরিসংখ্যান যা ভয় ধরায়

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) দেশব্যাপী এক জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষকে সাপে কামড়ায় এবং তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার জনের মৃত্যু হয়, যা মোট সাপে কামড়ানো মানুষের ২ শতাংশ।

আরও দেখা যায়, সাপের কামড়ের ৯৫ শতাংশ ঘটনা গ্রামীণ এলাকায় ঘটে। নারীদের চেয়ে পুরুষরা চারগুণ বেশি সাপের কামড়ের শিকার হয়।

২৫ হতে ৫৫ বছর বয়সী পুরুষেরা বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যা থেকে মাঝরাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সর্পদংশনের শিকার হন। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দংশিত অঙ্গে গিঁট দেন এবং ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রথমেই 'ওঝা' বা প্রচলিত চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেন। 

সর্পদংশনের পরে প্রতি হাজারে ২ জন মানুষের অঙ্গহানীর ঘটনা ঘটে। ২২ থেকে ২৩ ভাগ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী শারিরীক অসুস্থতা ভোগ করেন। ১০ শতাংশ মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী অবসাদ গ্রস্ততায় ভোগেন। 

আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০.৬ শতাংশের শারিরীক অক্ষমতা এবং ১.৯ শতাংশের মানসিক অক্ষমতা দেখা দেয়। দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার গৃহপালিত পশু সর্পদংশনের শিকার হয় এবং এতে প্রায় আড়াই হাজার পশু মারা যায়। 


 সাপের কামড়জনিত মোট মৃত্যুর ৬৫% ঘটে শুধু বর্ষা মৌসুমেই

সর্বাধিক আক্রান্ত অঞ্চল: সুন্দরবন ঘেঁষা খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কক্সবাজার।

সবচেয়ে ঝুঁকিতে কারা?
কৃষক, খোলা মেঝেতে ঘুমানো শিশু ও বৃদ্ধ, দিনমজুর, মাছ ধরতে যাওয়া মানুষ, বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ, যারা স্কুল বা বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নেয়, রাত জাগা সিকিউরিটি গার্ড।


জানা জরুরী: কী করবেন?

১. আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার আশ্বস্ত করতে হবে এবং সাহস দিতে হবে, আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না।

২. রোগীকে আধশোয়া অবস্থায় রাখুন।

৩.আক্রান্ত অঙ্গ অবশ্যই স্থির রাখতে হবে। হাতে কামড়ালে হাত নাড়ানো যাবে না। পায়ে  কামড়ালে হাঁটাচলা করা যাবে না, স্থির হয়ে বসতে হবে।

৪. আক্রান্ত অঙ্গ ব্যান্ডেজের সাহায্যে চাপ দিয়ে প্যাঁচাতে হবে। ব্যান্ডেজ না পাওয়া গেলে গামছা, ওড়না বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে।

৬. যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

কী করবেন না

১.  কোনোভাবেই চিকিৎসার জন্য ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

২. শক্ত বাঁধন/গিঁট দেওয়া যাবে না। অনেক সময় দেখা যায়, হাত বা পায়ে কামড় দিলে, কামড়ানো জায়গা থেকে ওপরের দিকে দড়ি বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়, যাতে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। বরং এতে হাত/পায়ে রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে রক্ত প্রবাহের অভাবে টিস্যুতে পচন (Necrosis) শুরু হতে পারে।

৩. কামড়ানোর স্থানে ব্লেড, ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করা যাবে না।

৪. কিছু মানুষের ধারণা, আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ বের করলে রোগী ভালো হয়ে যাবেন। বিষ রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা এভাবে বের করা সম্ভব নয়। কোনো অবস্থাতেই আক্রান্ত স্থানে মুখ দেবেন না।

৫. ব্যাথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।


সাপের কামড়ের একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা: এন্টিভেনম!

সাপের বিষ এক ধরনের প্রাণঘাতী প্রোটিন, যা শরীরে প্রবেশের পর দ্রুত স্নায়ু, হৃদপিণ্ড বা রক্তে বিষক্রিয়া ঘটায়। এতে রোগীর অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে এবং দ্রুত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়।

এই বিষ প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা হলো — “এন্টিভেনম” (Antivenom)।
এটি সাপের বিষ থেকে তৈরি একটি বিশেষ প্রতিষেধক, যা সময়মতো প্রয়োগ করলে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করে জীবন রক্ষা করতে পারে।

 যা জানা জরুরি:

১/ এন্টিভেনম যত দ্রুত প্রয়োগ করা যায়, রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি।
২/ শুধুমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকই সঠিক মাত্রা ও পদ্ধতিতে এটি প্রয়োগ করতে পারেন।
৩/ ওঝা বা ঝাড়ফুঁক নয়—সঠিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়া বাধ্যতামূলক।
৪/ WHO অনুযায়ী, দ্রুত চিকিৎসা দিলে সাপের কামড়ে মৃত্যুহার ৫% এর নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।


সচেতনতার দায় আসলে কার?

সাপের কামড়ে মৃত্যুর পর আমরা প্রায়শই শুনি—"সচেতনতার অভাবে প্রাণ গেছে"। এই বক্তব্য একপেশে হলেও জনপ্রিয়, কারণ এতে পুরো দায়টা চাপিয়ে দেওয়া যায় ভুক্তভোগীর ওপর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষের সেই সচেতনতা আসবে কোথা থেকে?

একজন কৃষক, দিনমজুর কিংবা গ্রামের শিক্ষার্থী কখন জানতে পারবে কীভাবে সাপের কামড়ের পর সঠিক চিকিৎসা নিতে হয়, যদি—

তার গ্রাম বা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এন্টিভেনমই না থাকে?
কোথায় গেলে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া যাবে, সেই তথ্য তাকে কেউ জানায় না?
আশেপাশে ওঝা বা ঝাড়ফুঁক প্রথাই সহজলভ্য হয়?


সচেতনতা নিজে থেকে জন্মায় না। সচেতনতা গড়ে তুলতে হয়—শিক্ষার মাধ্যমে, প্রচারের মাধ্যমে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, বিশ্বাসযোগ্য ও প্রস্তুত একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে। যদি হাসপাতালেই না থাকে প্রাথমিক প্রতিষেধক, তাহলে মানুষ ওঝার কাছেই যাবে, সেটাই স্বাভাবিক।

 সরকার কী করতে পারে এখনই?
১. প্রতিটা উপজেলা পর্যায়ে অন্তত ৫০টি অ্যান্টিভেনম ভায়াল সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২. প্রতিটি গ্রামে/ইউনিয়নে একটি করে ‘সাপ দংশন চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র’ চালু করা যায়।
৩. ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যদল দিয়ে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ঘুরে প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া যেতে পারে।
৪. “ঝাড়ফুঁক নয়, ভ্যাকসিন দিন”—এই বার্তা নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে স্থানীয় ভাষায়, পোস্টার ও মাইকিং-এর মাধ্যমে।


সাপের বিষ যতটা ভয়াবহ, অব্যবস্থা ও অবহেলাও ততটাই প্রাণঘাতী। মানুষ মরছে শুধুমাত্র অজ্ঞতা নয়, রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির অভাবেও। প্রতি বছর এক বর্ষা আসে, আর একঝাঁক মানুষ চলে যায়। চলে যায় কেবল একটি ইনজেকশন না পাওয়ার কারণে। আমরা বলি ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট হেলথ কেয়ার—কিন্তু একটি অ্যান্টিভেনমও যদি সময়ে পৌঁছায় না, তাহলে সেই স্মার্টনেস কোথায়?

এখন সময়, বর্ষার সাথেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার। না হলে আগামী দিনগুলোতে সংবাদ শিরোনামে আরও শিশু, কৃষক, দিনমজুরের নাম থাকবে—একটি বোতল ও একটি সিদ্ধান্তের অভাবে।

আলীম

×