
১৯২৯ সালে রিকশার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থা যত প্রসারিত হয়, মোটর ও অন্যান্য যান যত প্রচলিত হয়, পালকির ব্যবহার তত কমতে থাকে। এভাবে বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে।পালকির ইতিহাস ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে দেব-দেবীর আরোহণ বা দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেও পালকি দিয়ে দেবতা বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়ণেও আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে ইউরোপের উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই পালকিতে চলাচল করতেন। তবে উপমহাদেশে রেলগাড়ির প্রচলেনর পর ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মাঝে পালকির ব্যবহার অনেকটাই কমে আসে।
পালকি চলে! পালকি চলে! গগন তলে আগুন জ্বলে! স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গাঁয়ে যাচ্ছে কারা রুদ্র সারা! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’ কবিতাটি গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পালকির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামবাংলা এমনকি শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে পালকি চাই-ই চাই। যেন পালকি ছিল এক আভিজাত্যের প্রতীক। নারীদের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে জড়িত ছিল পালকি। আর পালকি ছাড়া তো গ্রামের বিয়ে কল্পনা করা যেত না। পালকি সাধারণত তিন ধরনের ছিল সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি ছিল আয়তকার। চারিদিকে কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছাদ ঢালু। এর দুই দিকে দুটি দরজা থাকত। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকত। ময়ূরপঙ্খি ছিল আয়তনে সবচেয়ে বড়। এর ভেতর বসার জন্য পালঙ্কের মতো আসনও করা হতো।
পালকিগুলোতে পাখি, পুতুল, লতাপাতা ও আকর্ষণীয় কারুকার্য নকশা করানো থাকত। পালকি বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট ও সাধারণ পালকি (ডুলি) দুজনে বহন করে। সবচেয়ে বড় পালকি বহন করে চার থেকে আটজন পালকি বাহক। পালকি বাহকদের বলা হয় বেহারা বা কাহার। হাডি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউডি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক পালকি বহন করে। এরা দিনমজুরের কাজ এবং মাছের ব্যবসাও করে। বেহারারা পালকি বহন করার সময় নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলে চলে।
চারকোনা বিশিষ্ট পালকি বহন করত চার থেকে ছয়জন সুঠাম দেহের পুরুষ, যারা বেয়ারা নামে পরিচিত ছিল। দূরত্বভেদে বেয়ারাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। তারা পালকি নিয়ে ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ধ্বনিতে তালে তালে পা ফেলে, সুরেলা ছন্দময় ধ্বনিতে তাদের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলত। গ্রামীণ সেই চেনা আঁকাবাঁকা, মেঠোপথে বেয়ারারা নববধূকে বরসহ শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া আসা করত। বেয়ারাদের হুনহুনা ধ্বনিতে মুখরিত দৃশ্য দেখতে পথের ধারে জড়ো হতো গায়ের বধূসহ, মা-চাচি এমনকি উঠতি বয়সের চঞ্চল মেয়েরাও। নবীন-প্রবীণ, তরুণ-তরুণী, বালক-বালিকাদের হৈ-হুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে এক আনন্দঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হতো।
মানব চাকা ব্যবহার করে পালকি চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাইলের পর মাইল। সভ্যতার ক্রমবিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, বিজ্ঞানের আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতীক পালকির প্রচলন। এখন আর আগের মতো পালকির ব্যবহার চোখে পড়ে না। মেয়েরা আর পালকিতে চড়ে বিয়ের স্বপ্ন বোনে না। বিয়েতে পালকির সেই স্থান দখল করে নিয়েছে জাঁকজমক সাজানো প্রাইভেট কার। অথবা ঘোড়ার গাড়ি।
ইতিহাস বলছে, একসময় অভিজাত শ্রেণির মানুষ ও রাজরাজাদের ও প্রধান বাহক ছিল পালকি। রকমারি ও বাহারি রূপে ছিল পালকি। পালকির ব্যবহার কখন কীভাবে এ দেশে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে মোঘল, পাঠান আমলে বাদশা, সুলতান, বেগম ও শাহজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করত। মুসলিম সম্প্রদায় মেয়েদের পর্দা রক্ষার জন্য পালকিতে চড়ে অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে বাড়ির বাইরে যাতায়াত করত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীনকালে তাদের বউ মেয়েদের যাতায়াতের জন্য পালকি ব্যবহার করত। বিলাসী পরিবারগুলো নিজস্ব পালকি ও নিজস্ব বেয়ারা রাখত।
অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবার যাতায়াতের জন্য ভাড়ায়চালিত পালকি ব্যবহার করত। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
ঐতিহাসিকদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে উনিশ পালকির কদর কমে যায়। ১৯২৯ এর দশকে শহর অঞ্চলের রিকশার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার উঠেই গেছে। পালকির বদলে যাতায়াতের জন্য এসব সহজ যানবাহনের পথ বেছে নেয়।
কালক্রমে ঐতিহ্যের বাহক পালকি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। রাজা নেই, বাদশা নেই, নেই পালকির বেয়ারারা। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সময়। এখনকার বধূরা আর পালকিতে চড়ে লাজরাঙা মুখে শ্বশুরবাড়ি যায় না। তবে কেউ কেউ শখের বশে পালকির আয়োজন করে, যাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুনত্ব আসে। কেউ বা নাটক-সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য পালকির খোঁজ করে। তবে আগের মতো পালকির সেই আমেজ আর চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু এখনও কোথাও কোথাও পালকির দেখা মেলে। বিশেষ করে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের লোক ও কারুমেলায় বর-কনের বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রকৃত পালকির অনুরূপ ককসিট দিয়ে বানানো পালকি দেখা যায়। গ্রামবাংলার এই প্রাচীন বাহন পালকি সংরক্ষণ করতে হবে। না হলে এ ঐতিহ্যময় পালকি স্থান নেবে শুধু জাদুঘরে কিংবা বইয়ের পাতায়। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মকে পালকি দেখতে লোক শিল্প জাদুঘরে যেতে হবে, কৃত্রিমভাবে সাজানো পালকি দেখার জন্য।
Mily